করোনাভাইরাস, পুলিশ ও আমরা, কে কোথায় দাঁড়িয়ে?

সুভাষ দত্ত (পরিবেশবিদ)

ঘটনাটা প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো। আমাদের পাড়ার বস্তি বস্তি গন্ধটা সবে যাই যাই করছে। চায়ের দোকান বন্ধ করে খগেশ দাস মাঝরাত ছুঁই ছুঁই সময়ে বাড়ি ফিরছে। পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। হাতে দুটো ছোট ব্যাগ। হঠাৎ দেখলেন, একটা লাইটপোস্টে আগুন লেগেছে। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে দিলেন দৌড়। এক ছুটে পৌঁছোলেন হাওড়া থানায়। কোন কথাই বলতে পারলেন না, শুধু হাউ-হাউ করে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করলেন। লুঙ্গিটা গেল খুলে। প্রথমে পাগল ভাবলেও পুলিশ দমকলকে খবর দিল। আগুন নিভলো।

এটা নিছকই একটা মজার ঘটনা নয়। মাঝরাতের অগ্নিকান্ডে কেন উনি এক দৌড়ে থানায় পৌঁছে বাকরুদ্ধ হলেন, সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। পরে ওনাকে জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিয়েছিলেন, “মাথার ঠিক ছিল না।”

আসলে মানুষ অবচেতন মনে পুলিশের ওপর এতখানিই নির্ভরশীল। ছেলে কিছুতেই ঘুমোচ্ছে না, মা ভয় দেখাচ্ছেন, “শিগগির ঘুমোও, নইলে পুলিশ ডাকবো।” মাঝরাতে উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের স্বামী-স্ত্রীর হাতাহাতি, কেউ একজন চেঁচাচ্ছে, পুলিশ, পুলিশ। আমাদের সামনে পুলিশ, পেছনে পুলিশ, ডাইনে পুলিশ, বাঁয়ে পুলিশ এমনকি মনেও পুলিশ গেঁথে আছে। অঞ্জন দত্তের ‘তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হোত না’ গানটার কথায় বলতে ইচ্ছে হয় ‘পুলিশ, তুমি না থাকলে রাজনীতিটাও এতো জম্পেস হত না।’
জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, কি না পুলিশকে করতে হয়। ওনাদের ভালো কোনও কাজের কৃতিত্ব নেন রাজনৈতিক দাদারা৷ আর একটু এদিক- ওদিক হলেই তাদের বদলি, সাসপেনশন বা কম্পালসারি ওয়েটিং চলে যেতে হয়।

এই মুহুর্তে আমরা করোনা- আক্রান্ত। এটা প্রতিরোধ করার জন্যও পুলিশকে নামতে হচ্ছে। লকডাউন বিধির মান্যতা হচ্ছে কি না, তা দেখতে পুলিশকে লাঠিচার্জও করতে হচ্ছে। পুলিশ মার খাচ্ছেন, পুলিশ বাড়াবাড়ি করছে বলে বিস্তর অভিযোগও উঠছে। পুলিশের মাথা ফাটছে, হাত কাটা পড়ছে, আরও কত কি! কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবেছেন যে জনসাধারণকে সুরক্ষিত রাখতে পুলিশ কতটা অসুরক্ষিত হয়ে পড়েছেন।
গণআন্দোলন করতে গিয়ে আমি বহুবার পুলিশের লাঠি খেয়েছি। আমার কিন্তু খুব কম সময়েই মনে হয়েছে যে পুলিশ অন্যায় করছে বা জুলুম করছে। আমি রাস্তা আটকে আন্দোলন করছি, বিরাট বিরাট মিছিল হচ্ছে, অবস্থান করছি, ঘেরাও-অবরোধ করছি, তাতে পুলিশ হস্তক্ষেপ করতেই পারে। একবার হাওড়া পুলিশ সুপারের অফিস অবরোধ অভিযান করলাম। বেধড়ক লাঠিচার্জ হলো৷ পাল্টা ইটবৃষ্টিও ঘটলো৷ জাল লাগানো হেলমেট মাথায় একজন পুলিশ অফিসার স্পটেই আমাকে জাপটে ধরে রইলেন। আমি ভাবলাম গ্রেপ্তার হয়েছি। হঠাৎ একটি আস্ত ডাব ওই অফিসারের মাথায় পড়লো। উনি ঐ অবস্থাতেই আমাকে বললেন, “সুভাষবাবু, আপনাকে বাঁচাতে আমি মার খাচ্ছি।” পরের দিন সংবাদপত্রে দেখলাম যে পুলিশ সুপার স্বয়ংই আমাকে জাপটে ধরে ছিলেন।

আরও একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। বেকারি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হলাম। রাত্রি ১০টায় আমাদের থানার লকআপে পোরা হোল। তখন শীতকাল, ভোর সাড়ে পাঁচটায় চাদর মুড়ি দিয়ে বড়বাবু আমাকে ডাকলেন। একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। বললেন, ‘লকআপের বাথরুম নোংরা, খুব খারাপ, আসুন আমার বাথরুমটা ব্যবহার করুন।’ তখন হাওড়া থানার দোতলায় একদিকে লকআপ আর অন্যদিকে বড়বাবুর আবাস ছিল। আমি ওনার বাথরুমে গেলাম। যখন বেরিয়ে আসছি, দেখলাম এক কাপ চা ও বিস্কুট নিয়ে উনি দাঁড়িয়ে। বললেন, “আমার মিসেস এখানে নেই, আমি নিজের হাতেই আপনার জন্য চা বানিয়েছি, না খেলে দুঃখ পাবো।” বেলা ১০টায় লকআপ থেকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের৷ সিঁড়ির দুপাশে পুলিশ কর্মীরা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আমাদের বিদায় জানিয়েছিলেন।

এই পুলিশকে আমি দেখেছি। আবার ‘৬০-এর দশকে কমিউনিস্টদের বিখ্যাত স্লোগানটাও শুনেছি, “পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো।” কেন জানিনা এখন তাই মনে হচ্ছে, যদি পুলিশ না থাকতো, তাহলে আমাদের কি হত।

করোনা প্রতিরোধেও পুলিশ আজ রাস্তায় নেমেছে। অথচ এটা তাঁদের করার কথাই নয়। আমরাই আইন অমান্য করছি বলেই ওঁদের লাঠি ধরতে হয়েছে। উল্টে ওঁদেরকেই গালমন্দ করছি। পুলিশের সাথে অসংখ্যবার লড়াই করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে আজ বলছি, “দয়া করে এখন অন্ততঃ পুলিশের সাথে সহযোগিতা করুন। ওঁরাই এখন আমাদের রক্ষক৷ লকডাউনটা মানুন।”

Previous articleলকডাউন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সওয়াল ৯রাজ্যের
Next articleবাংলার করোনা পরিস্থিতির সাম্প্রতিকতম আপডেট দেখে নিন