তাৎপর্যহীন এই ‘মে দিবস’! কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

ক্লিশে হওয়া কথাগুলো ফের একবার…

মে দিবস শোষণমুক্তির শপথ নেওয়ার দিন, সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার শপথ নেওয়ার দিন। শ্রমিকশ্রণির আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন। মে মাসের প্রথম দিনটি কীভাবে মে দিবসে পরিণত হলো সে ইতিহাস প্রায় সবার জানা৷ ১৮৮৬-র মে মাসে হে মার্কেটের ঐতিহাসিক সেই শ্রমিক বিক্ষোভে রোজ ১২-১৫ ঘন্টার বদলে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার আদায়-ই ছিলো অন্যতম প্রধান দাবি। সেই জয়ের উল্লাস স্বীকৃতি পেয়েছে দুনিয়াজুড়ে৷

আজ ১৩৪ বছর পর করোনা-আবহে যখন ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে, সেই চেষ্টার প্রতিবাদ না করে,আজ এই ১ মে তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস’ পালন করা স্রেফ নাটক বলেই মনে হচ্ছে৷

করোনা-পর্বে আজ গোটা বিশ্বের একাধিক দেশের সঙ্গে ভারত-ও দৈনিক সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টার শ্রম-সময় বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করতে চলেছে৷ শিল্পমহলের আর্জিতে শ্রম-আইনে স্থায়ী সংশোধন ঘটিয়ে অর্ডিন্যান্স আনার কথা ভাবছে কেন্দ্র। চালু থাকা শ্রম-আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইতিমধ্যেই রাজস্থান, গুজরাট, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ সরকার সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-কে সামনে এনে, ‘শ্রমিক কম’ দোহাই দিয়ে সংশোধন করেছে ১৯৪৮ সালের ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট৷ আইনি সিলমোহর দেওয়া শ্রম-সময় ৮ ঘণ্টার বদল ঘটানোর বিষয়টি ‘সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে’ বলে উল্লেখ করেছে কেন্দ্র৷ এই ফাঁক কাজে লাগিয়েই দেশের কয়েকটি রাজ্য ১২ ঘণ্টার কাজের সময় নির্ধারিত করেছে। ১৯১৯-এ ILO-র প্রথম সনদে ৮ ঘণ্টার বিষয় স্বীকৃত ছিলো।১৯২১ সালের বৃটিশ সরকারও তা মেনে নেয়। আজ যখন ‘পিছনের দিকে গৌরবের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার’ চেষ্টা হচ্ছে, তখন পয়লা মে, তথাকথিত “আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস” পালন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে৷ ডান বা বাম, কোন রাজনৈতিক দল এই কাজের প্রতিবাদ করেছে ? অথচ টুইটে তারাই আজ শ্রমিক সমাজকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, মেহনতি মানুষের সংগ্রামকে কুর্ণিশ জানিয়েছেন৷ এই ‘সক্রিয়তা’কে কোন বাক্যে শ্রদ্ধা জানানো হবে ?

একটি প্রতিবেদনে দিনকয়েক আগে পড়লাম, করোনা-কারনে চালু থাকা লকডাউনের মধ্যেই এপ্রিলের মাঝামাঝি ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ নামে এক সংস্থা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে৷ ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে বেকারত্বের হার এই মুহুর্তে অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২৬.১%। লকডাউনে সরাসরি কর্মচ্যুত হয়েছেন সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। সাড়ে ৮ কোটি মানুষ এখন যে কোনও কাজের খোঁজে মরিয়া হয়ে ঘুরছে।
অনেকেরই মনে আছে, ২০১৯-এ NSSO বা ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিলো, গত ৪৫ বছরের মধ্যে ভারতে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ ৬.১% হয়েছে৷ আর করোনা- আবহে তা এখনই পৌঁছে গিয়েছে ২৬.১%-এ৷ কোথায় গিয়ে থামবে, কেউ জানে না৷ এর পরে আজ কোন তাৎপর্য বহন করছে প্রতিবাদহীন এই ‘মে দিবস’? কোনও রাজনৈতিক নেতানেত্রী মুখ খুলেছেন ? অথচ এরাই তো আজ শ্রমিকশ্রেণীর উদ্দেশ্যে বাণী বিতরণ করছেন৷

আরও একটি বিষয় আছে, তবে এটি আমি সঠিকভাবে জানিনা, শুনেছি৷ ভুল শুনে থাকলে ক্ষমা করবেন এবং এখানেই সঠিক তথ্য-নথি দিয়ে সংশোধন করে দেবেন, তাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি উপকৃত হবো৷ শুনেছি, কেন্দ্রীয় সরকার শ্রম-সংস্কারের মোড়কে যা ভেবেছে তাতে নাকি শ্রমজীবী মানুষের বেতন বিষয়ক কোড’টি, নাম যার, “কোড অন ওয়েজেস”, সেটিকে আইন করেছে। ফ্লোর ওয়েজের তকমা লাগিয়ে প্রায় সব শিল্পে ন্যূনতম দৈনিক মজুরি নির্দিষ্ট হয়েছে মাত্র ১৭৮ টাকায়। কতখানি ভয়ঙ্কর ! সবাই জানেন, এই মুহুর্তে দেশের বহু শিল্পে চালু থাকা দিনমজুরি এই ১৭৮ টাকার দ্বিগুণ বা তারও বেশি। একইসঙ্গে শুনেছি এবং এক্ষেত্রেও ভুল শুনে থাকলে সংশোধনও আশা করছি যে সামাজিক সুরক্ষা,শিল্প-সম্পর্ক, কাজের পরিবেশ এবং শ্রম-স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিলও নাকি তৈরি হয়ে গিয়েছে৷ যে কোনও মুহুর্তে তা আইন হিসেবে লাগু হয়ে যাবে৷ শিল্প-সম্পর্ক কোডে নাকি
স্থায়ী কাজ বা চাকরি প্রসঙ্গটাই ছেঁটে ফেলা হয়েছে৷ নতুন আইন আসছে কর্মী বা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করার পদ্ধতি নিয়েও৷ সেই আইনও এমন হয়েছে, যেখানে আগামিদিনে ইউনিয়ন গঠন করাই কঠিন হবে৷ দৈনন্দিন শ্রম-ঘন্টা ৮ ঘণ্টার থেকে বাড়িয়ে ১০-১২ ঘন্টা হচ্ছে দেশজুড়েই৷

আজ এই মে -দিবসে একটা কথাই ঘুরছে মাথায়, সত্যিই যদি এ ধরনে শ্রম-আইন কোনও না কোনও অছিলায় দেশজুড়ে লাগু হয়, সেই আইন কি আদৌ কোনও বাছ-বিচার করবে ? আমি বিজেপি মনোভাবাপন্ন শ্রমিক বলে কাজের সময় বৃদ্ধি পাবেনা, দৈনিক মজুরি ১৭৮ টাকায় নির্দিষ্ট হবেনা, আর আপনি তৃণমূল বা কংগ্রেস বা সিপিএম বলে আপনার ঘাড়েই এসব কোপ পড়বে ? এখানেও কি হিন্দু- মুসলিম দেখা হবে ? এমন হয় নাকি ?

জার্মান কবি ফ্রেডরিক গুস্তাব এমিল মার্টিন নেমলার (Friedrich Gustav Emil Martin Niemöller) একটি কবিতায় লিখেছিলেন,

First they came for the socialists, and I did not speak out—
Because I was not a socialist.

Then they came for the trade unionists, and I did not speak out—
Because I was not a trade unionist.

Then they came for the Jews, and I did not speak out—
Because I was not a Jew.

Then they came for me,

and there was no one left to speak for me.

আসলে এই সংকটকালে তেমন কিছু রাজনৈতিক কথা বলতে চাইছি না৷ আমি শুধু জিজ্ঞাসা করছি,
যদি একটা বুলডোজার আপনার ওপর দিয়ে চলে যায়, কি হতে পারে আপনার ?

সত্যিই এমন কিছু হলে আপনার শরীর গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে৷ হাড়গোড় ভেঙে চুরচুর হবে৷ আপনার শরীরের ভেতর থাকা লাল রক্ত বেরিয়ে আসবে গলগল করে৷ ভিজিয়ে দেবে রাস্তা অথবা মাঠ৷ আপনার অস্তিত্বটাই আর থাকবে না।

সবশেষে দেখা যাবে আপনি আর নেই, আপনার জায়গায় পড়ে আছে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কিছু মাংসপিন্ড।

Previous articleমোদিকে ফোন করতেই ফাঁড়া কাটল, মহারাষ্ট্র বিধান পরিষদে নির্বাচনের তোড়জোড়
Next articleলকডাউন: নয়া নির্দেশিকা জারি কেন্দ্রের