সুশান্তয় কেঁদে ভাসব আর গোষ্ঠদের উপেক্ষা করব! আমরা অসভ্য, কুণাল ঘোষের কলম

কুণাল ঘোষ

সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু দুঃখজনক। মর্মান্তিক।

শুনেই খারাপ লেগেছে।
এবং চিন্তার বিষয়ও বটে।

একটা জলজ্যান্ত ছেলে দুম করে চলে গেল।
ছেলেটিকে ভালোই লাগত।

এই বয়সের একটা ছেলেকে চলে যেতে হল কেন এইভাবে?

এক, যদি আত্মহত্যাই হয়, কেন এই অবসাদ? কেন এই সিদ্ধান্ত? আর্থসামাজিক বিশ্লেষণ চলবে। নানা কথা শোনা যাবে।

দুই, যদি আত্মহত্যা না হয় ! এই তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়েও কিছু জল্পনা চলবেই।

প্রচারমাধ্যম- মূলস্রোত ও সোশ্যাল মিডিয়া আপাতত সুশান্তময়।
ফিল্মস্টার- তাই এখবর বিক্রির সুবিধে। মানুষও হাঘরের মত তাকিয়ে এই খবরের দিকে।

আমি মনখারাপের পক্ষে।
কিন্তু মায়াকান্নার পক্ষে নই।

সুশান্তর মৃত্যুর ঠিক কী কারণ, আমি জানি না। তাই এই লেখায় তার মধ্যে ঢুকব না।

তবে এটা বলব, আমাদের চারপাশে কত মানুষ অবসাদে, কত মানুষ আত্মঘাতী, কেউ খবর রাখেন?
মৃত্যুর পর চোখের জল ফেলা সহজ; মৃত্যুর আগে তাদের মন বোঝার চেষ্টা হল কি? পাশে দাঁড়ানো গেল কি?
আত্মহত্যা হলেই অবসাদের পরিণতি ও প্রকাশ। তার আগে পর্যন্ত অবসাদ শুনলে ‘খিল্লি’ করে ন্যাকামি বলা, এইসব কি ভুলে যাব?

এই যে আমি, অস্বাভাবিক পরিশ্রম ও সাধনায় তিলতিল করে নিজের কেরিয়ার তৈরির পর এক ভয়ানক চক্রান্ত ও অবিচারে যখন ধ্বংস হয়েছি; জেলের কুঠুরিতে জীবনের অন্ধকারে ডুবতে থেকেছি; জ্ঞানত কোনো দোষ না করে কলঙ্কিত হয়েছি, ভেবেছেন কখনও, কোন্ ধরণের অবসাদ আমার ছিল? আগুপিছু না জেনে এখনও যে গুটিকয় জানোয়ার আমার পোস্টে ঢুকে সবজান্তার মত ভাব করে বিরূপ মন্তব্য লেখে; তারাও অনেকে কাল সুশান্তর অবসাদে মায়াকান্না কেঁদেছে। সেটাও কারণ না জেনে। এখানে কাঁদতে হবে, কারণ ফিল্মস্টার।

খরাতে কৃষকের আত্মহত্যা; বন্ধ কারখানার শ্রমিকে আত্মহত্যা; অজানা চক্রান্তে জড়িয়ে ফেঁসে যাওয়া আত্মহত্যা- আমরা কাঁদি কতটুকু?

দুদিন আগে কর্মহীন যুবক বাধ্য হয়ে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের হাতে মারা গেছে। সুন্দরবনে ।
খবরের শিরোনামে আসেনি। তার অবসাদ আমরা জানতাম? দিনের পর দিন কোন অবসাদে থাকলে অনভ্যস্ত এক যুবক ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরতে বাঘের ডেরায় যেতে বাধ্য হন, আমরা ভাবব? আমরা তাঁর নামটুকুও জানব?

পরিযায়ী শ্রমিক কিশোরী জামলো মাকদাম লকডাউনে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে রাস্তায় মারা গেলো। তার অবসাদ? তার শেষকৃত্যের খবর?
স্টেশনে মায়ের মৃতদেহের পাশে খেলল অবোধ শিশু। মৃত্যুর আগে সেই মায়ের অবসাদটা আমরা অনুমান করার চেষ্টা করব?

আমরা সবাই, সমাজ, সিস্টেম- আমরা অসংখ্য মানুষকে অবিরাম ঠেলে দিচ্ছি অবসাদের মুখে।

আমরা সবজান্তা। আমরা জ্ঞানপাপী।
এখন আমরা ব্যস্ত সুশান্তর অবসাদ নিয়ে।
আর আমাদের চারপাশে যে অবিরাম এক অবসাদচক্র গ্রাস বাড়াচ্ছে; বিশেষত এই করোনাযুদ্ধের লকডাউনপর্বে সর্বনাশা চেহারা নিচ্ছে অবসাদ; সেখানে আমরা সাধ্যমত চারপাশ ঠিক রাখতে আমাদের কর্তব্যপালন করছি তো?

সুশান্তর মৃত্যু চরম দুঃখের।
আজকের ঘূর্ণিবিশ্বের দৌড়ে বিধ্বস্ত এই পরিণতির ময়নাতদন্ত জরুরি।

কিন্তু সেই সঙ্গেই জরুরি কাজ হারিয়ে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের মুখে প্রাণ হারানো যুবকের অবসাদ ও অসহয়তার মূল্যায়ন। কই, এর মৃত্যুতে তো কেউ টুইট করেন না। দেশনেতানেত্রীদের প্রাণ কাঁদে না। এখনও রোজ জীবন হাতে নিয়ে পেটের দায়ে বাঘ আর কুমীরের জলজঙ্গলেই যেতে হয় মানুষকে। সুশান্ত শিরোনাম আর গোষ্ঠ নাইয়া উপেক্ষিত; এ আমাদের দ্বিচারিতা। ইটভাটায় কাজ হারিয়ে বাবা, মা, স্ত্রী, তিন সন্তানকে নিয়ে চরম অবসাদে পড়া গোষ্ঠ শেষে জঙ্গলে যেতে বাধ্য হন। বাঘের কামড়ে মৃত্যুর পরেও তিনি কাগজের পেজ ওয়ান পান না।
আমরা আবার বড় বড় কথা বলি!
( এই লেখার সঙ্গে সুশান্তর ছবির পাশে গোষ্ঠর ছবি থাকল)

শুধু ফিল্মস্টারকে নিয়ে চোখের জল ফেললে তাকে মায়াকান্না ছাড়া কিছু বলতে আমি রাজি নই।

ফিল্মস্টার আর উচ্চবিত্ত মারা গেলেই টিভিতে অবসাদের ব্যাখ্যা দেবেন বিশেষজ্ঞরা; আর অসংখ্য শ্রমীজীবীর অসহায় কান্না অবসাদের সংজ্ঞার বাইরে রাখা হবে- এই অসভ্যতা সমর্থন করি না।

Previous articleফি বৃদ্ধি : এবার বাঁশদ্রোণীর ডি’পল স্কুলে অভিভাবকদের বিক্ষোভ
Next articleকরোনা আবহেই খুলল কামারপুকুর শ্রী রামকৃষ্ণ মঠ