ওই দ্যাখ, ওখানেই জ্যোতিবাবুর বাড়ি ছিল!

সুদীপ্ত বোস

‘‘একটি পাগলও কিছুকাল ধরে রোজ সকালে উঠে জ্যোতিবাবুর বাড়ির সামনে এসে নিয়ম করে তাঁর পার্টিকে অশ্রাব্য ভাষাতে গালিগালাজ দিয়ে বক্তৃতা করতো। জ্যোতিবাবুর পুলিশেরা তাকেও অবশ্য কিছু বলতেন না। মাঝে মাঝে শোভাযাত্রাকারীরা আসত বটে স্লোগান দিতে দিতে, সামনের মোড় থেকে তাদের ঘুরিয়ে দেওয়া হতো, বাড়ি অবধি পৌছাতে দেওয়া হত না। জ্যোতিবাবুর জন্য পাড়ার শান্তি বিঘ্নিত হয়নি কখনও।

একটা সময় ছিল যখন রোজ সকালে যতীন চক্রবর্তী আসতেন, জ্যোতিবাবুর বাড়ি থেকে তাঁর সঙ্গে একত্রে অফিস যাবেন বলে। আবার লালীরও বাসা ছিল জ্যোতিবাবুর উঠোন। তার সেখানেই বছর বছর বাচ্চা হতো, পুলিশেরা তাকে যত্নআত্তি করতেন। আমাদের সেই লালী যেদিন মারা গেল পাড়াতে সত্যি সত্যি ঘনিয়ে উঠলো শোকের আবহাওয়া। কে বলবে রাস্তার কুকুর……………

কোন এককালে জ্যোতিবাবুও দোতলায় ছিলেন। নিজের গেঞ্জিটা নিজে কেচে এনে শুকোতে দিতেন দেখেছি।আমার মেয়েদের কোলে বসিয়ে আদর করতেন। একদিন জিজ্ঞেস করেছেন হ্যাঁ রে, আমাকে তুই চিনিস? মেয়ে বললো, তুমি তো জ্যোতি। আমরা লজ্জায় অধোবদন।

মনে পড়ছে, যখন রোজ রোজ লোডশেডিং হত আর দুষ্টু লোকে বলতো জ্যোতিবাবুর পাড়াতে লোডশেডিং হয় না, তখন আমরা ইনভার্টারের কৃপায় গোটা দুই আলো পাখা চালালেও, জ্যোতিবাবু আর কমলদি কিন্তু তিনতলার দক্ষিণের বারান্দাতে বসে থাকতেন অন্ধকারে হাত পাখা নিয়ে। ইনভার্টারও ব্যবহার করতেন না। সে সব অন্যরকম দিনকাল ছিল…..’’

কত মানুষ কত রকম ভাবে জ্যোতি বসুকে আগলে রেখেছেন তাঁদের স্মৃতিতে।
নদীর ধারে ভাটার চরে গ্রামের শেষপ্রান্তে একেবারে প্রান্তিকতম মানুষটার কাছে ‘লাল পার্টি’ মানে এখনও ‘জ্যোতিবাবুর পার্টি’, কারখানার শ্রমিকের কাছে জ্যোতিবাবু মানে ধর্মঘটের অধিকার, কৃষকের কাছে ফসলের অধিকার….
আরার শহরে নবনীতা দেব সেনের মতো অধ্যাপক-কবি-সাহিত্যিকের (যার নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ) কাছে জ্যোতিবাবুর ব্যক্তিত্ব ধরা পড়েছে এমনই ক্যানভাসে।
নবনীতা দেব সেন শেষ করছেন এই বলে, ‘‘ ওই দ্যাখ্‌ , ওখানেই জ্যোতিবাবুর বাড়ি ছিলো’ বলে আমিই একদিন আঙুল তুলে দেখাবো নতুন লোকজনকে, যেমন দেখাই মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়ার পরী।’

আগুনের পরশমনি…

Previous articleবিজেপি সভাপতির মায়ের ভর্তিও আমরাই করাই: মমতা
Next articleভাইরাস রুখতে এবার ‘কামান গাড়ি’ নামাচ্ছে কলকাতা পুরসভা!