রান আউটে শুরু-রান আউটেই শেষ, ধোনির ক্রিকেট বৃত্তের মাঝেরটা ইতিহাস!

দেশের ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় ইনস্টাগ্রামে যখন নিজেকে “অবসরপ্রাপ্ত” ক্রিকেটার হিসেবে ধরে নিতে বললেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, তখন কি তাঁর ভারতের জার্সিতে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটির কথা ভীষণভাবে মনে পড়ছিল? ভীষণভাবে কি মনে পড়ছিল ২০১৯ ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের রুদ্ধশ্বাস সেমিফাইনাল ম্যাচটি?

ফ্ল্যাশ ব্যাক-১

২০০৪ সালের ডিসেম্বর। ভরা ক্রিকেট মরশুম। টিম ইন্ডিয়ার বাংলাদেশ সফর। চট্টগ্রামে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটেছিল লম্বা সোনালী চুলের এক তরুণ ক্রিকেটারের। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে জায়গা হয়েছিল প্রথম একাদশে। তবে শুরুটা ছিল হতাশায় ঘেরা। ম্যাচে ব্যাট করতে নেমে কোনও রান করার আগেই সাজঘরের পথ ধরেছিলেন ধোনি। মহম্মদ রফিকের বলে শর্ট স্কোয়ার লেগে বল ঠেলে দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম রানটা তুলে নিতে চেয়েছিলেন ধোনি। কিন্তু ব্যর্থতাই সঙ্গী হয়েছিল তাঁর। তাপস বৈশ্যর থ্রোয়ে বাংলাদেশ উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ যখন স্টাম্প ভেঙে দিলেন, তখন ধোনি নিজের ভবিষ্যৎটা অন্ধকারই দেখছিলেন। শুধু ধোনি কেন, আরও অনেকেই তেমন ভেবেছিলেন।

সেদিন এম এ আজিজ স্টেডিয়াম হাজির বাংলাদেশি দর্শক কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখা ভারতের সমর্থকরা সম্ভবত ভাবতেও পারেননি, “ডাক” হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়া ধোনিই কেরিয়ার শেষ করবেন ইতিহাসের অন্যতম সফল ও সেরা ক্রিকেটার ও ক্যাপ্টেন হিসেবে।

ফ্ল্যাশ ব্যাক-২

একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস। ক্রিকেট বিধাতার তৈরি স্ক্রিপ্ট।

বিন্দু থেকে বিন্দুতে মিলেছে বৃত্ত। দীর্ঘ ১৫ বছরের বর্ণময় ক্রিকেট কেরিয়ারের শুরুটা ঠিক যেভাবে শুরু হয়েছিল, শেষটাও হলো সেভাবে। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে রান আউট দিয়ে শুরু আর মাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে রান আউটেই শেষ। ২০১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দলের বিপর্যয়ের মুখে ৫০ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেললেন ধোনি। সেই ইনিংস ভারতকে প্রায় ফাইনালে তুলেই দিয়েছিল। কিন্তু রান আউটে আশার সমাধি। ধোনির দেড় দশকের কেরিয়ারেরও। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের ৪০০ দিনের মাথায় সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটালেন তিনি ছোট্ট এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে—”আমাকে অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হিসেবে ধরে নিন।”

ফ্ল্যাশ ব্যাক-৩

শুরু আর শেষের দুই রান আউটের মাঝের সময়টা অবশ্য অবিশ্বাস্য। দুর্দান্ত। ইতিহাস। আসলে চট্টগ্রামের রান আউটের পরই বাইশ গজ থেজে ড্রেসিং রুমে ফেরার ওই কয়েক সেকেন্ডেই ধোনি বোধহয় নিজের ক্রিকেট জীবনের রূপকথার গল্পের স্ক্রিপ্ট নিজেই লিখবেন ঠিক করে ফেলে ছিলেন। দুই রান আউটের মাঝেরটা ইতিহাস। ইংরেজিতে যাকে বলে “রোলার কোস্টার রাইড”। নিজেকে প্রমাণ করা থেকে শুরু করে ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হওয়া। ভারতীয় ক্রিকেটে নিজের ব্যক্তিত্ব-বুদ্ধিমত্তাজে ব্যবহার করে সেরার সেরা হয়ে ওঠা। ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা নেতার আসনে নিজেকে অধিষ্ঠান করা। নিজের বরফশীতল স্নায়ুকে উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

“শূন্য” থেকে “সিংহ দুয়ার”

অভিষেক ম্যাচে “শূন্য”। পরের তিনটি ইনিংসে যথাক্রমে ১২, নটআউট ৭ ও ৩। এই ধারাবাহিকতা চলতে গিয়ে যখন দল থেকে বাদ পড়ার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে চূড়ান্ত “ব্রেক থ্রু”! এবার ক্রিকেট দুনিয়া চিনলো মাহিকে। বিশাখাপত্তনমে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে ১২৩ বলে ১৪৮ রানের ম্যাচ উইনিং এক ইনিংস দিয়েই রূপকথার যাত্রার শুরুটা রচনা করলেন ধোনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে কাঁপিয়ে দেওয়া সেই সেঞ্চুরিই তাঁকে পথ করে দিল নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। তিন নম্বরে নেমে করা সেই সেঞ্চুরিটি তাঁকে ভারতের মিডল অর্ডারের নির্ভরশীলতায় পরিণত করল। চওড়া ব্যাটে একের পর এক ম্যাচ জিতিয়ে
অচিরেই এক ম্যাচ উইনারে পরিণত হলেন তিনি। এম এস ডি নামের সঙ্গে জুড়ে গেল “গ্রেট ফিনিশার” শব্দযুগল।

“গ্রেট ফিনিশার” থেকে “ক্যাপ্টেন কুল”

অধিনায়ক হিসেবে তাঁর শুরুটাও রূপকথার গল্পের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে ভারত উড়ে দক্ষিণ আফ্রিকায়। দলের “থ্রি- মাস্কেটিয়ার্স” শচীন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও রাহুল দ্রাবিড়কে ছাড়াই। ধোনির হাতে তুলে দেওয়া হলো টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়কের ব্যাটন। তারুণ্য নির্ভর একটা দল নিয়ে ধোনি নিজের নেতৃত্বের পরীক্ষায় পেলেন একশোয় একশো। ফাইনালে শেষ ওভারের খাতাবি লড়াইয়ে সেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়েই ট্রফিতে চুম্বন দিলেন ধোনি।

এরপর থেকে শুধুই সাফল্যের এভারেস্টে উত্তরণ। ২০১১ সালে ভারতকে এনে দিলেন ৫০ ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা। ক্লাইভ লয়েড, কপিল দেব, ইমরান খান, অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিংদের মতো কিংবদন্তিদের নামের পাশে নিজের নামটিও খোদাই করে রাখলেন।

প্রশ্রয় নেই আত্মতুষ্টির

একের পর এক ইতিহাস গড়ে ভারতীয় ক্রিকেটে সাফল্যের জোয়ার আনলেও, সেই জোয়ারে গা ভাসাননি মাহি। কিছুতেই যেন খিদে মেটে না তাঁর। কিছুতেই সন্তুষ্ট করা গেল না ধোনিকে। ২০১৩ সালে জিতলেন আরেক আইসিসি পরিচালিত ট্রফি। দেশের হয় এবার “মিনি বিশ্বকাপ” চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির খেতাব যোগ হলো ধোনির সাফল্যের মুকুটে। ২০১৫ সালে অধিনায়ক হিসেবে ভারতকে আরেকটি বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছাকাছি নিয়ে গিয়েও নতুন করে রূপকথাটা আর লেখা হয়নি।

“বিদায় লগ্নেও গ্রেট ফিনিশার”

ধোনির ক্রিকেট জীবনও সেলুলয়েডের পর্দায় “এমএস ধোনি” বায়োপিকের মতোই নাটকীয়। বিদায়বেলায় সেটাই বুঝিয়ে দিলেন ছোট্ট এক ইনস্টা পোস্টে—”এখন থেকে আমাকে অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হিসেবে ধরে নিন।” আসলে যে মানুষটার জীবন নিয়ে বক্স অফিস হিট ছবি হতে পারে, তাঁর ক্ষেত্রে এমনটাই তো স্বাভাবিক। ক্রিকেটের বাইশ গজের মতোই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে “গুড বাই” বলাটাও ছিল একেবারেই “গ্রেট ফিনিশার” স্টাইলেই!!!

Previous articleআমফানের ক্ষতিপূরণ মেটাতে  ১ লাখ ফলের গাছ লাগানোর পরিকল্পনা, উদ্যোগী ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ 
Next articleপথ দেখালো রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠান, বসানো হলো করোনা প্রতিরোধক ‘সাইকো ক্যান’