অনুক্ত ‘কংগ্রেস রেডিও’, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

 

কণাদ দাশগুপ্ত

বিয়াল্লিশের ২৭ আগস্ট৷
আজ থেকে ৭৮ বছর আগের ঠিক আজকের দিন৷

হঠাৎই রেডিও-তে ভেসে এলো এক নারীকন্ঠ, “This is Congress Radio calling on a wavelength of 42.34 meters from somewhere in India….”
“কংগ্রেস-রেডিও থেকে আমি ভারতের কোন এক জায়গা থেকে ৪২.৩৪ মিটার বেতার তরঙ্গে বলছি…”

এর কিছুদিন আগে, ‘৪২-এর ৯ আগস্ট শুরু হয়েছে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন৷ বৃটিশ সরকার
চুপ করে বসে সেই আন্দোলন দেখছিলো, এমন নয়৷ মহাত্মা গান্ধী-সহ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির নেতাদের একের পর এক গ্রেফতার করতে শুরু করে পুলিশ৷ স্বতঃস্ফূর্ত সেই ‘ভারত- ছাড়ো’ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ৷ ভারতরক্ষা আইনে আটক হন প্রায় ১৮ হাজার রাজনৈতিক কর্মী।

ঠিক সেই সময়ে ডঃ রামমনোহর লোহিয়ার পরিকল্পনায় কংগ্রেসের সর্বক্ষণের এক মহিলা কর্মী, ঊষা মেহতার উদ্যোগে চালু হলো এক অসামরিক গোপন বেতারকেন্দ্র, নাম, ‘সিক্রেট কংগ্রেস রেডিও’। এর উদ্দেশ্য, বৃটিশ-বিরোধী প্রচার চালানো আর নেতা ও সাধারণ কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখা৷
লোহিয়া তো ছিলেনই, এই অনন্য উদ্যমকে স্বাগত জানিয়ে পাশে দাঁড়ালেন, ভিটলদাস খক্কর, বাবু ভাই টক্কর, চন্দ্রকান্ত জাভেরি প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি৷ তৎকালীন বোম্বাই-এর কোনও এক গোপন আস্তানা থেকে বেতার সম্প্রচারে ভেসে এল এই ঊষা মেহতা’রই কণ্ঠস্বর, “This is Congress Radio calling on a wavelength of 42.34 meters from somewhere in India….”৷

‘কংগ্রেস-রেডিও’-র প্রথম সম্প্রচার হয়েছিলো ১৯৪২-এর ২৭ আগস্ট৷ তারপর ১৯৪৩-এর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ, এবং ১৯৪৪-এর জানুয়ারিতে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য। ওই গোপন ডেরা থেকেই ১৪ আগস্ট হয়েছিলো ‘কংগ্রেস রেডিও’-র ‘ট্রায়াল’ সম্প্রচার৷
‘কংগ্রেস রেডিও’-র এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ভারত-ছাড়ো আন্দোলনের কাজ অনেক সহজ হলো। ইংরেজ পুলিশের কাছে যেগুলি নিষিদ্ধ খবর, সেগুলি বিনা বাধায় দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে উঠছিলো৷ দেশের অন্যান্য রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সন্তর্পণে নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রচারের কাজ চলতে ‘কংগ্রেস-রেডিও’-র মাধ্যমে৷ তবে প্রতি মুহুর্তে ছিলো পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়৷
পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য প্রায় রোজই প্রচার কেন্দ্রের ঠিকানা বদলাতে হতো৷ তবুও এই বেতার কেন্দ্র চালু ছিলো৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক ভারতীয় টেকনিশিয়ানের বিশ্বাসঘাতকতায় ‘কংগ্রেস-রেডিও’-র সন্ধান পেয়ে যায় পুলিশ। ১২ই নভেম্বর বেতারকেন্দ্রের প্রধান ঊষা মেহতা-সহ সকলেই গ্রেফতার হন। ৬ মাস আটক রেখে টানা জেরার মধ্যেও বহু প্রলোভনেও তিনি মুখ খোলেননি৷ বৃটিশ পুলিশ একটি শব্দও বার করতে পারেনি৷ ফলে
ঊষা মেহতাকে কারাবাস ভোগ করতে হয় ৪ বছর৷

কে এই ঊষা মেহতা ?

সুরাতের খেরার প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রী ঊষা মেহতা ( ১৯২০-২০০০) ছাত্রাবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নেন তিনি আজীবন কংগ্রেস কর্মী থাকবেন, সংসার করবেন না। ১২-১৩ বছরের মেয়েটি খাদির পোশাকই ব্যবহার করতেন ছোটবেলা থেকেই৷ বড়দের সঙ্গে মদের দোকানে পিকেটিং করতেও যেতেন ওই ছাত্রকালেই। লেখাপড়া শেষ করে ২২ বছর বয়স থেকে কংগ্রেসের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলেন। গান্ধীজির জীবনদর্শনই হয় তাঁর আদর্শ।

ঊষা মেহতা অসম্ভব ঝুঁকি নিয়েই কংগ্রেস-রেডিওর সাহায্যে গোপনে ইংরেজবিরোধী প্রচার চালাতেন, নেতা, সাধারণ কর্মী ও দেশের অন্যান্য প্রদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন৷ পুলিশের চোখে ধুলো প্রায় রোজই প্রচারকেন্দ্রের জায়গা বদল হত। কংগ্রেস- রেডিওর মাধ্যমে আন্দোলনের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে। ইংরেজ পুলিশের কাছে যেগুলি ছিল নিষিদ্ধ খবর, সেগুলিই বিনা বাধায় জনতার কাছে পৌঁছে দিতেন ঊষা। ফলে, সারা দেশে আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব হয়েছিল সহজেই।

তবে হাত গুটিয়ে বসে ছিলো না পুলিশ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ শেষ পর্যন্ত ‘কংগ্রেস- রেডিও কেন্দ্রের সন্ধান পায় ৩ মাস পর, ৪২-এর ১২ নভেম্বর। বেতারকেন্দ্রের প্রধান ঊষা মেহেতা-সহ সবাই গ্রেপ্তার হন। পুলিশি গোয়েন্দারা তাঁকে ৬ মাস ধরে জেরা করে৷ এই ৬ মাস জেলের একটি সেলে একা আটক থেকেও তাঁর মনোবল ভাঙেনি। কংগ্রেসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তাঁকে বিদেশে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেওয়া হবে, এমন প্রলোভনও দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ঊষা ছিলেন নির্বাক। এমনকি বিচারের দিনগুলিতেও তিনি একটি প্রশ্নেরও উত্তরে দেননি। নিজেকে বাঁচাবার জন্যও তিনি কোনও চেষ্টাই করেননি । আদালত তাঁকে ৪ বছরের জন্য জেলে পাঠায়। পুণের ইয়ারাভেদা জেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল। তিনি মুক্তি পান ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে।

এ ছিলো বোম্বাইয়ের ঘটনা। ওদিকে ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীনই রামমনোহর লোহিয়ার উদ্যোগে কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দল কলকাতাতেও একটি গোপন বেতারকেন্দ্র চালু করে। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পূর্ণই অনুপস্থিত৷ মুম্বইয়ে ঊষা মেহতা পরিচালিত ‘কংগ্রেস রেডিও’ সম্পর্কে অনেকেই জানেন, কিন্তু কলকাতার ওই একই প্রচেষ্টার কথা সম্পূর্ণ অজানাই থেকে গিয়েছে৷ কলকাতার এই বেতারকেন্দ্র মূলত ৪ জনের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে৷ তাঁরা হলেন, উদয়ন চট্টোপাধ্যায়, তাঁর ভাই সম্বরণ চট্টোপাধ্যায়, মোহন সিং স্যাণ্ডার ও দিলীপকুমার বিশ্বাস। কলকাতার এই ‘নিষিদ্ধ’ প্রথম বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি অনুষ্ঠান ৪১.৬৮ মিটার ব্যান্ড,শর্ট ওয়েভ-এ পরিচালনা করতেন দিলীপকুমার বিশ্বাস৷ হিন্দিতে বলতেন মোহন সিং স্যাণ্ডার৷ সম্পূর্ণটাই ছিল রামমোহন লোহিয়ার পরিকল্পনা৷ রাত ৯টা থেকে শুরু হত অনুষ্ঠান৷
সেই একই ‘সিগনেচার ইনট্রো’,
“This is a Congress Radio Calling from somewhere in India. Hallo everybody! Here is the news…’ এই কথাগুলিই বলেই খবর পড়া শুরু করতেন উদয়ন চট্টোপাধ্যায়৷ সঙ্গে থাকতেন উদয়নের অনুজ সম্বরণ৷ দিলীপকুমার বিশ্বাস পড়তেন কথিকা৷ এই খবর শোনা যেত উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। আবহাওয়া ভালো থাকলে তখনকার বর্মাতেও এই সম্প্রচার শোনা যেত৷ প্রথম দিকে রাত ৯টা থেকে ৯.১৫ পর্যন্ত চলতো সম্প্রচার৷ জনপ্রিয়তা পাওয়ায় পরের দিকে আরও বেশি সময় ধরে চলতো এই অনুষ্ঠান৷ সে সময় বৃটিশ পুলিশের Anti- Piracy Detection Van ঘুরে বেড়াতো কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়৷ পুলিশকে ফাঁকি দিতে এক একদিন এক-এক জায়গা থেকে সম্প্রচার হত৷ সম্প্রচারের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাছা হতো ভাড়া বাড়ি৷পরিত্যক্ত কোনও জায়গা থেকেও চলতো ‘কংগ্রেস রেডিও’-র বেতার সম্প্রচার৷ উদয়ন চট্টোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হন ১৯৪৩ সালে৷ তবে এই বেতার সম্প্রচারের একটি কথাও পুলিশ তাঁর কাছ থেকে জানতে পারেনি৷ দিলীপকুমার বিশ্বাস ধরা পড়েননি কখনও৷ দিলীপকুমার বিশ্বাস ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের এক দিকপাল ঐতিহাসিক৷

(প্রকাশমান গ্রন্থের একটি অংশ)

Previous articleলকডাউনেও দোকান খোলা কোচবিহারে, বন্ধ করল পুলিশ
Next articleচালু হচ্ছে ব্রেস্ট অ্যান্ড এন্ডোক্রিন সার্জারি ক্লিনিক, নেতৃত্বে বাংলার কৃতি চিকিৎসক