দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আপনি এই যুদ্ধও হেলায় জয় করবেন

সুখেন্দু শেখর রায়

সাংসদ, রাজ্যসভা

আমার সঙ্গে প্রণবদার প্রথম পরিচয় ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে, বরকতদার কলকাতার বাসভবনে। মালদহের জনাকয়েক নেতার মধ্যে আমিও ছিলাম।

প্রথম দর্শনেই তিনি আমাকে আকৃষ্ট করেন। বরকতদা বললেন, প্রণববাবু মালদহ লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন । তোমরা এখন থেকে কাজে নেমে পড় । প্রণবদা তখন কেন্দ্রে ব্যাঙ্কিং ও রাজস্ব দপ্তরের স্বাধীন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী । তাঁর নির্দেশে হাজি মস্তান, সুকুর বাখিয়ার মত কুখ্যাত স্মাগলাররা ধরা পড়ে । বিভিন্ন শিল্পপতিদের বাড়ি-অফিসে হানা দিয়ে আয়কর দপ্তর প্রচুর ধনসম্পদ উদ্ধার করে। তাই তখন প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে শিরোনামে থাকতেন প্রণবদা ও তাঁর মন্ত্রকের নানা রুদ্ধশ্বাস ঘটনার বিবরণ । এরপর লোকসভা নির্বাচন হল ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে। জরুরি অবস্থাজনিত কারণে সারাদেশে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটে। ইন্দিরা গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী, প্রণবদা-র মত অনেক কংগ্রেস নেতা হেরে যান।আমি যেহেতু প্রণবদা-র নির্বাচনে প্রচার কমিটির দায়িত্বে ছিলাম, আমার সঙ্গে রণকৌশল নিয়ে প্রায় নিয়মিত আলোচনা হত। ফলে তাঁর নিকট সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে। ১৯৭৮ সালে কংগ্রেস দু’ টুকরো হয়ে পড়ে । জন্ম হয় ইন্দিরা কংগ্রেসের। বরকতদা রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি । প্রণবদা সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ। সদ্যপ্রয়াত সোমেনদা তখন যুব কংগ্রেসের সভাপতি। আমি সাধারণ সম্পাদক । ১৯৮০ সালের নির্বাচনে প্রণবদা বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হলেন। এবারেও ভাগ্যলক্ষী তাঁর প্রতি প্রসন্ন হলেন না। আমি দেড় মাস বোলপুরে তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত ছিলাম। তাই প্রণবদার পরাজয়ে আমি খুব মুষড়ে পড়ি । কিন্তু প্রণবদার মনে পরাজয় আদৌ কোন রেখাপাত করেছে কিনা বোঝা যেত না, যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি দু-দুবার লোকসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আক্ষেপ বহুবার আমার কাছে প্রকাশ করেছেন।

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সকাশে সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় (২০১২)

তো, ফলপ্রকাশের আট-দশদিন পরে এক দুপুরে রেডিওর খবরে শুনলাম, প্রণবদা ইন্দিরা মন্ত্রিসভার বাণিজ্য ও ইস্পাত দপ্তরের মন্ত্রী হয়েছেন। ফোনে অভিনন্দন জানালাম। বললেন, চলে আয়। এক নেতার কাছ থেকে বিমানের টিকিট যোগাড় করে প্রথমবার আকাশপথে আমার দিল্লিযাত্রা । তারপর যত দিন গিয়েছে, ততই তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে। প্রণবদার বাবা মারা গিয়েছেন। সেদিন সারা কলকাতায় নাগাড়ে বৃষ্টি হওয়ায় চারিদিক ডুবে গিয়েছে। বুক সমান জল। আমি একটা ম্যাটাডোরে চেপে ঢাকুরিয়া থেকে কোনওভাবে বেলগাছিয়ায় পৌঁছাই। এইভাবে নিজের অজান্তেই যেন একসময় প্রণবদার পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলাম। দল ছাড়লেও তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অটুট ছিল।
কিছুদিন আগেও তো ফোনে কথা হয়। ভালই কথাবার্তা হল। অথচ এখন…।

তাঁর মত কোনও নেতাকে রাজধানীর রাজনীতির সেন্টার স্টেজে চার দশকেরও বেশি সময় শক্ত হাতে লাগাম ধরে টিঁকে থাকতে দেখিনি। সাপ-লুডোর খেলায় মাত্র একবারই অল্প সময়ের জন্য অবনমন ঘটেছিল। কিন্তু সমস্ত ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল কাটিয়ে অচিরেই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন রাজীব গান্ধীর । ইউপিএ-১ ও ইউপিএ-২-র শাসনকালে তিনিই ছিলেন ভারচুয়াল প্রধানমন্ত্রী । ৪০টি মন্ত্রিগোষ্ঠীর সভাপতি হয়েছেন। বিদেশ, অর্থ , প্রতিরক্ষার মত গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রক সামলেছেন। রামদেব ও আন্না হাজারের আলাদা দুটো সমাবেশ-ধরণাকে গুরুত্বহীন করার পিছনেও ছিল তাঁর নেপথ্য ভূমিকা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও দেশের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য রেখে গ্যাট চুক্তিই হোক অথবা আমেরিকার সাথে অসামরিক পারমানবিক চুক্তি – তিনি অসামান্য দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

একবার তাই প্রণবদাকে বলেছিলাম, আপনি যে কোনও সঙ্কটের মুহুর্তে বিশল্যকরণী কীভাবে খুঁজে পান? মুচকি হেসে আমাকে বলেছিলেন, তার মানে তুই আমাকে পবনপুত্রের সঙ্গে তুলনা করছিস!

প্রণবদা, আপনি মহাবলী ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু অবিশ্বাস্য স্মৃতিধর এমন মহান রাষ্ট্রনায়ক, ভূভারতে আগামীদিনেও তার তুলনা মেলা ভার হবে। আপনি প্রকৃত অর্থেই ভারতরত্ন ।

আপনি নেই, একবারের জন্যও কেউই তা মানতে চাইছে না। একটিবার চোখ মেলে চেয়ে দেখুন, কত মানুষ এখনও আপনার জন্য প্রার্থনা করে চলেছেন৷ আপনি কত যুদ্ধ জয় করেছেন। সব যুদ্ধ সবার নজরে হয়তো আসেনি। কিন্ত রাজনীতির অন্দর মহলের লোকেরা তা জানে, আপনার ঘনিষ্ঠজনেরা জানে। আপনার একনিষ্ঠ ভক্ত হওয়ার সুবাদে আমিও জানি।

তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আপনি এই যুদ্ধও হেলায় জয় করবেন। কিন্তু তা ভাবনাতেই থেকে গেলো৷ আপনার সমস্ত অনুরাগীদের মত আমিও ঈশ্বরের কাছে আপনার শান্তি কামনা করছি।

আরও পড়ুন :  প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়

Previous articleকেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা না করে লকডাউনের দিন অপরিবর্তিত রেখে রাজ্যের চ্যালেঞ্জ
Next articleপ্রণব মুখোপাধ্যায়, একটি যুগের নাম