মিরাটি থেকে রাইসিনা : এক সুমহান যাত্রা

◾১৯৩৫ সালের ১১ডিসেম্বর বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রণব মুখোপাধ্যায় ৷

◾২০২০ সালের ৩১ অগাস্ট রাজধানী দিল্লির সেনা হাসপাতালে প্রয়াত হন প্রণব মুখোপাধ্যায় ৷

◾প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের কাছে মিরাটি গ্রামে। বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ও মা রাজলক্ষ্মী দেবী। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকালে কামদাকিঙ্কর ১০ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে কামদাকিঙ্কর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য (১৯৫২-৬৪) হন৷ কামদাকিঙ্কর বীরভূম জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদও অলংকৃত করেন।

◾প্রণব মুখোপাধ্যায় সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন৷ এই কলেজটি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ছিল।

◾প্রণব মুখোপাধ্যায় কলেজের অধ্যাপক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি সাংবাদিকের কাজও করেন কিছুকাল। এই সময় তিনি ‘দেশের ডাক’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি ও পরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিও হন৷

◾প্রণব মুখোপাধ্যায় কর্মজীবনে প্রথম দিকে হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় অবস্থিত ‘বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল’-এ ২ বছর শিক্ষকতা করেন।

◾প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কর্মজীবন ছিলো ছয় দশকব্যাপী। তিনি একাধারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা ছিলেন, অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন একের পর এক। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেসের শীর্ষ মুশকিল-আসান নেতা।

◾ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে প্রণববাবু দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন ২০১২ সালের
২৫ জুলাই, এই পদে ছিলেন ২০১৭-র ২৪ জুলাই পর্যন্ত৷

◾প্রণববাবু দেশের অর্থমন্ত্রী হন ২৪ জানুয়ারি, ২০০৯, ওইপদে ছিলেন ২০১২-র ২৬ জুন পর্যন্ত ৷ এর আগে ১৫ জানুয়ারি, ১৯৮২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৮৪ পর্যন্তও তিনি ছিলেন দেশের অর্থমন্ত্রী ৷
◾ভারতের বিদেশমন্ত্রী হিসাবে প্রণববাবুর কাজের মেয়াদ ছিলো ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ থেকে ১৬ মে, ১৯৯৬ পর্যন্ত৷

◾ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন
২২ মে, ২০০৪ থেকে ২৬ অক্টোবর, ২০০৬ পর্যন্ত৷

◾ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব ছিলেন ২৪ জুন, ১৯৯১ থেকে ১৫ মে, ১৯৯৬ পর্যন্ত ৷

◾কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ১৯৮৬ সালে প্রণববাবু রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস গঠন করেছিলেন৷ ১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস মিশে যায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে৷

◾স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হন ২০১৫ সালে৷ তিন সন্তান, শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায়৷

◾১৯৬৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হন। এরপরই রাজনৈতিক কর্মজীবনে তার দ্রুত উত্থান শুরু হয়। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীতে পরিণত হন৷ ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় স্থান পান। ১৯৮২-৮৪ পর্বে তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার দলনেতাও ছিলেন।

◾প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিদেশ, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, রাজস্ব ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব পালনের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। দলের প্রতি আনুগত্য ও অসামান্য প্রজ্ঞা এই বাঙালি রাজনীতিবিদকে কংগ্রেস দলে ও এমনকি দলের বাইরেও বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র করেছে। দেশের প্রতি অবদানের জন্য তাকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ ও শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে, যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন। ২০১৯ সালে তিনি ‘ভারতরত্ন’ হন৷

◾প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় ৫ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথম বার কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।

◾১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন।

◾ক্যাবিনেটে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতির পর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর মধ্যে অন্যতমের শিরোপা দেওয়া হয়।

◾তাঁর মন্ত্রিত্বকালে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের ঋণের শেষ কিস্তির ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ না তোলা। তিনি যখন অর্থমন্ত্রী, ড. মনমোহন সিং তখন ছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর।

◾ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার অব্যবহিত পরে দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব্ব্বের শিকার হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই সময় রাজীব গান্ধী তাঁকে ক্যাবিনেটে স্থান দেননি। কিছুকালের জন্য তাঁকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করেছিলো।

◾এই সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজস্ব একটি দল গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পর এই দল তুলে দিয়ে তিনি ফের কংগ্রেসে যোগ দেন।

◾পরবর্তীকালে পি. ভি. নরসিমা রাও তাকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করার পর তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবনের পুনরুজ্জীবন ঘটে।

◾রাওয়ের মন্ত্রিসভায় পরে তিনি ক্যাবিনেট মন্ত্রীরূপেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন।

◾প্রণব মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসেরও সভাপতিও ছিলেন। ২০০৪ সালে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাজ্যসভার সদস্য হওয়ায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতার দায়িত্ব পান। উল্লেখ্য, সেই বছরই তিনি প্রথমবার জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন।

◾প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহন, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের মতো একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব গ্রহণের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী।

◾তিনি সারা দেশের কংগ্রেস সাংসদ ও বিধায়কদের নিয়ে গঠিত যথাক্রমে কংগ্রেস সংসদীয় দল ও কংগ্রেস বিধানসভা দলেরও প্রধান ছিলেন। পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাইপাস সার্জারির সময় তদনীন্তন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজনীতি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্যাবিনেট পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন।

◾ভারতের বিদেশমন্ত্রী হিসাবে প্রণব মুখোপাধ্যায়, মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে, ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর প্রণব মুখোপাধ্যায় ও ইউএস সেক্রেটারি অফ স্টেট কন্ডোলিজা রাইস সেকশন ১২৩ চুক্তি সই করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অফ গভর্নরসের সদস্য।

◾১৯৮৪ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত গ্রুপ অফটোয়েন্টিফোরের সভাপতিত্ব করেন।

◾১৯৯৫ সালের মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি সার্ক মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেছিলেন।

◾২০০৬ সালের ২৪ অক্টোবর প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বে তার পরিবর্তে আসেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা কেরালার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. অ্যান্টনি।

◾এই সময় ভারতের রাষ্ট্রপতির পদে তার নাম সাময়িকভাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু পদটি নিছক আনুষ্ঠানিক হওয়ায়, কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটে তাঁর অবদান ও কার্যকরিতার কথা মাথায় রেখে তাঁর নাম বিবেচনা থেকে প্রত্যাহৃত হয়।

◾ বিদেশ মন্ত্রকে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্বগুলি হল, প্রথমে মার্কিন সরকারের সঙ্গে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অসামরিক পরমাণু চুক্তি সই ও পরে নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফিকেশন ট্রিটি সই না করেই করেই নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ারস গ্রুপের থেকে অসামরিক পরমাণু বাণিজ্যের অনুমতি আদায়।

◾২০০৭ সালে তাকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ দ্বারা সম্মানিত করা হয়।

◾অনিচ্ছাসত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধী রাজনীতিতে যোগদান করতে সম্মত হলে প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রধান সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন সমস্যা সোনিয়ার শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধী কিভাবে সমাধান করতেন, তার উল্লেখ করে তিনি সোনিয়াকে সাহায্য করতেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্নাতীত আনুগত্য ও প্রজ্ঞা তাকে সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিংয়ের ঘনিষ্ঠ করে তোলে। ২০০৪ সালে দল ক্ষমতায় এলে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সম্মানজনক দায়িত্বটি পান।

◾২০০৫ সালে পেটেন্ট অ্যামেন্ডমেন্ট বিল পাসের ক্ষেত্রে তিনি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও এই বিলটি সরাসরি তার মন্ত্রক বা তার দায়িত্ব তালিকাভুক্ত ছিল না।

◾প্রণববাবু রাজনৈতিকভাবে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী ছিলেন৷ ছিলেন একজন বাস্তববাদী। রিডিফকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে তাঁর সরকারের দুর্নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন,
“দুর্নীতি একটি ইস্যু। আমাদের ইস্তাহারে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই জানাচ্ছি যে কেলেংকারি কেবল কংগ্রেস বা কংগ্রেস সরকারের মধ্যেই আবদ্ধ নেই। অনেক কেলেংকারি রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই এই ধরনের কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত। তাই কংগ্রেস সরকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত; এমন কথা বললে বিষয়টি লঘু করে দেখানো হবে।”

◾মনমোহন সিংহের দ্বিতীয় সরকারে প্রণব মুখোপাধ্যায় ফের অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব পান। উল্লেখ্য, ১৯৮০-এর দশকে তিনি এই মন্ত্রকেরই দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ২০০৯ সালের ৬ জুলাই তিনি সরকারের বার্ষিক বাজেট পেশ করেন। এই বাজেটে তিনি কয়েকটি কর সংস্কারের প্রস্তাব রাখেন। যেমন, ‘অস্বস্তিকর’ ফ্রিঞ্জ বেনেফিট ট্যাক্স ও কমোডিটিজ ট্র্যানজাকশান ট্যাক্সের অবলোপন ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ঘোষণা করেন যে অর্থমন্ত্রক শীঘ্রই গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স GST নামে একটি কর চালু করবে। এই করের কাঠামোটির প্রশংসা করেন বিভিন্ন কর্পোরেট কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদগণ। এছাড়াও তিনি কয়েকটি সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিতকরণ আইন, শিশুকন্যাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদি।

◾এছাড়াও অর্থবরাদ্দ করেন জাতীয় সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচি, বিদ্যুদয়ন প্রকল্প, এবং জওহরলাল নেহেরু জাতীয় নগরোন্নয়ন মিশনের মতো পরিকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতেও। যদিও কেউ কেউ তার অর্থমন্ত্রিত্বে রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

◾এনডিএ প্রার্থী লোকসভার প্রাক্তণ স্পিকার মেঘালয়ের ভূমিপুত্র পিএন সাংমাকে ৭১ শতাংশের বেশি ভোটে হারিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে ইউপিএ প্রাথী প্রণব মুখোপাধ্যায় নির্বাচিত হন। ২৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি। প্রণব পেয়েছিলেন ৫ লাখ ১৮ হাজার ৬৮৯টি ভোট, অন্যদিকে সাংমা পান দুই লাখ ৩২ হাজার ৫৫৮টি ভোট।

◾১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই প্রণব মুখোপাধ্যায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাদের দুই পুত্র ও এক কন্যা বর্তমান। তার অবসরকালীন শখ ছিলো বই পড়া, বাগান করা ও গান শোনা৷

◾প্রণব মুখোপাধ্যায় একাধিক সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৪ সালে ইউরোমানি পত্রিকার সমীক্ষায় তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী বলা হয়েছিল।

◾২০১০ সালে বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের দৈনিক সংবাদপত্র এমার্জিং মার্কেটস তাকে ‘”ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দ্য ইয়ার ফর এশিয়া” পুরস্কার দিয়েছিল।

◾২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে, দ্য ব্যাঙ্কার পত্রিকা তাকে “ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দ্য ইয়াস” সম্মান দিয়েছিল।

◾ভারত সরকার ২০০৮ সালে তাকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ প্রদান করেছিল।

◾২০১১ সালে উলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টর অফ লেটারস ডিগ্রি দেয়।

◾২০১২ সালের মার্চ মাসে অসম বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বেশ্বরায়া প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডি. লিট ডিগ্রি দেয়।

◾২০১৩ সালের ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট অফ ল ডিগ্রি দেয়। .

◾২০১৩ সালের ৫ মার্চ তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার “বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা” পান।

◾২০১৩ সালের ১৩ মার্চ মরিশাস বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টর অফ ল সম্মান দেয়৷ তিনি ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ভারতরত্ন পুরস্কারে সম্মানিত হন৷

◾প্রণববাবু রচিত গ্রন্থের চাহিদা আকাশছোঁয়া৷ তাঁর লেখা
মিডটার্ম পোল, বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল, এমার্জিং ডাইমেনশনস অফ ইন্ডিয়ান ইকোনমি অফ দ্য ট্র্যাক, সাগা অফ স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস
চ্যালেঞ্জ বিফোর নেশন অন্যতম৷

◾ভারতীয় রাজনীতির অনেক ঘটনার সাক্ষী প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঁচ বছরের সময়কালে লিখেছেন ইতিহাস নির্ভর তিন গ্রন্থ।

◾রাষ্ট্রপতির অন্যতম অধিকার ফাঁসির আসামির প্রাণভিক্ষা বিবেচনা করা। বছরের পর বছর পরে থাকা সেই সব আর্জির ফাইল ফেলে রাখেননি প্রণব। বেশ কয়েকজন ‘কুখ্যাত’ অপরাধীর প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ করেছেন তিনি। সেই তালিকায় ২৬/১১ মুম্বই হামলায় অভিযুক্ত আজমল কাসভ, সংসদ হামলায় অভিযুক্ত আফজল গুরু, মুম্বই বিস্ফোরণে অভিযুক্ত ইয়াকুব মেমনদের নাম রয়েছে। ১৯৮৬ সালে একই পরিবারের তেরোজনকে হত্যার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত গুরমিত সিংহের প্রাণভিক্ষার আর্জিও খারিজ করে দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। আবার, চারজনের প্রাণদণ্ডের সাজা বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করেছেন তিনি।

◾রাষ্ট্রপতি ভবনের ব্যাঙ্কোয়েট হল। ভারতে বরাবরের নিয়ম ছিল কোনও বিদেশি রাষ্ট্রনেতা এলে তাঁকে কোনও পাঁচতারা হোটেলে অতিথি হিসেবে রাখতে হয়। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাষ্ট্রপতি ভবনের ১২টি ঘরকে নতুন করে সাজিয়ে আধুনিক মানের অতিথিশালা বানিয়ে ফেলা হয়। এর জন্য অনেক খরচ হলেও বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য স্থায়ী খরচ কমে যায়। একটা সময়ে অবশ্য বিদেশি অতিথিরা রাষ্ট্রপতি ভবনের সাউথ কোর্টের গেস্ট হাউজে থাকতেন। ব্রিটেনের যুবরাজ চার্লস স্ত্রী ডায়নাকে নিয়ে এখানে থেকেছেন। কিন্তু পরে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নতুন করে তা চালু করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর আমলে রাষ্ট্রপতি ভবনে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন শেখ হাসিনা থেকে হামিদ কারজাই-সহ অনেকেই।

◾রাষ্ট্রপতি ভবনের অশোক হল।
একটা সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলেই হতো শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও শপথ নেন দরবার হলে। কিন্তু এই হলটিতে শব্দ প্রক্ষেপণের সমস্যা থাকায় পরবর্তীকালে তা বন্ধ হয়ে যায়। নরসিমা রাও, অটলবিহারী বাজপেয়ী থেকে মনমোহন সিংহের সময়ে শপথগ্রহণের স্থান তাই ঐতিহাসিক দরবার হল থেকে চলে যায় অশোক হলে। প্রণব মুখোপাধ্যায় ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনতে বিশেষজ্ঞদের এনে দরবার হলের শব্দ প্রক্ষেপন ব্যবস্থা ঠিক করেন। যদিও তাঁর আমলে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দরবার হলে শপথ নেননি। বড় মাপের অনুষ্ঠান করার জন্য বেছে নেন দরবার হলের সামনের লন।

◾রাষ্ট্রপতি ভবন এতকাল ছিল ভিভিআইপিদের জায়গা। সাধারণ মানুষের কোনও প্রবেশাধিকারই ছিল না। এখন আর তা নেই। দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা খুলে দিয়ে গিয়েছেন প্রণববাবু। চালু হয়েছে অনলাইন বুকিং। যার মাধ্যমে যে কেউ বেড়াতে যেতে পারেন ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক প্রধানের বাসভবন। গোটাটা ঘুরে দেখা যাবে। দেখতে পাবেন বিভিন্ন রাষ্ট্রপতিদের ব্যবহার করা সামগ্রী, তাঁদের পাওয়া উপহার। দেশের দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিল্প সংস্কৃতি ক্ষেত্রের কৃতীদের নিয়ে গিয়ে আধুনিকতম ব্যবস্থা করেছেন। দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ভাণ্ডার রাষ্ট্রপতি ভবনের লাইব্রেরিকে সম্পূর্ণ ডিজিটাইসড করেছেন বাঙালি রাষ্ট্রপতি।

আরও পড়ুন : দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আপনি এই যুদ্ধও হেলায় জয় করবেন

Previous articleলাদাখ সীমান্তে লাল ফৌজের প্ররোচনার আগে যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করে চিন
Next articleমোদিকে ডিসলাইক ! কমেন্টস সেকশন লক হলো