সর্বকালীন রেকর্ডের মুখে ভারতের অর্থনীতির সংকোচন

অমিতাভ সিংহ

অবশেষে পরিত্রান পেলেন নেহেরুজি। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম তিনমাসের আর্থিক ফল জানাচ্ছে জিডিপির সংকোচন হয়েছে চার দশকের সর্বাধিক – ২৩.৯%।

বেকারত্বের সূচক কয়েকমাস আগে গত ৫০ বছরে সর্বাধিক হওয়ার পর থেকেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে এই সরকারের আমলে দেশ দ্রুততার সাথে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন এবারে ব্যর্থতার দায় নেহেরুজির ওপর না চাপিয়ে ভগবান অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্রের ওপর চাপিয়ে নিজেদের পাহাড়প্রমান ব্যর্থতার একটা আড়াল খুঁজতে ব্যস্ত। যদিও তারই স্বামী ও সবচেয়ে কাছের মানুষ পরকলা প্রভাকর,যিনি নিজেও একজন অর্থনীতিবিদও বটে,বলেছেন ‘ “আসল দৈবদুর্বিপাক হল দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সরকারের সুসংহত ভাবনাচিন্তার অভাব।কোভিড তো দেরিতে এসেছে। আমি গত অক্টোবরেই বলেছিলাম যে সরকার অর্থনৈতিক ঝিমুনি অস্বীকার করছে।জিডিপির এই বিশাল সংকোচন তা প্রমান করল।ভগবানের দোহাই অন্তত এবার তো সরকার কিছু করুন।”তার পর থেকেই সীতারমন স্পিকটি নট।যদিও তার সহকর্মী মন্ত্রী পীযুষ গয়াল বা হরদীপ সিংহ এখনও বাগাড়ম্বর চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৪ সালের মধ্যে পাঁচ লক্ষ ডলারের অর্থনীতি হয়ে ওঠার স্তোতবাক্য।

এবার দেখা যাক বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংকোচনের চিত্রটা।
উৎপাদন শিল্প–২৩.৩%
নির্মাণ শিল্পে —-৫০.৩%
হোটেল,পরিবহন,যোগাযোগ শিল্পে –৪৭%
খনি,খাদান–২৩.৩%
সরকারি প্রশাসন–১০.৩%
বিদ্যুৎ ও গ্যাস শিল্পে –৭%।

এগুলি হিসাব করার সময় বিশেষ কিছু সূচকও বিবেচনার জন্য দেখা হয় যেমন রেল ও বিমানপথে যাত্রী পরিবহনসহ গাড়ী বিক্রয়,ইস্পাত ব্যবহার, সিমেন্ট উৎপাদন ইত্যাদি।ওপরের সংখ্যাতত্ব থেকে বোঝা যায় যে সেক্টরগুলিতে সবথেকে বেশী কর্মীরা কাজ করেন সেখানেই কোপ পড়েছে ব্যাপকভাবে। সম্ভবত এর জন্যেই ১৪ কোটি মানুষ কর্মহারা হয়েছেন। প্রায় ৫৫/৬০ কোটি পরিবারের মুখে একবেলা অন্নও জুটছে না। কিন্তু এটাই শেষ নয়। পরিসংখ্যানবিদদের মতে প্রকৃত বিপদের সম্পুর্ন চিত্রটি এতে ধরা পরেনি।

পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।তার প্রধান কারন হচ্ছে কর্পোরেট সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের চিত্র পুরোপুরি ধরা পড়ে না।জিএসটি থেকে লকডাউন এর ফলে অসংগঠিত ও ছোট ও মাঝারি শিল্পে ধাক্কা লেগেছে বেশী।যার ফলে পরিযায়ী শ্রমিক থেকে গরিব মানুষ রুটিরুজি হারিয়েছেন।মনে রাখতে হবে দেশে ৬.৫ কোটি ছোট ব্যাবসা আছে যেখানে কাজ হারিয়েছেন ১১ কোটি মানুষ। ভুললে চলবে না যে এই তিন মাসে নতুন লগ্নি কমছে ৪৭% যা ইতিহাসে প্রথম। সরকার বার বার বোঝাবার চেষ্টা করছে বা করবে যে বিশ্বজুড়ে কোবিদের জন্য সব দেশের জিডিপির হার কমেছে। যেমন আমেরিকার ৯.১%,ইতালীর১৭.৭%,জাপানের ৯.৯%,চীনের ৩.২% ইত্যাদি। কিন্তু ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক আগে থেকেই খারাপ চলছিল। বিশেষ করে নোট বাতিল ও ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি চালু হবার পর থেকেই।সরকার যতই অস্বীকার করুক না কেন এটাই সত্যি।না হলে শেষ অর্থবছরের শেষ তিনমাসে বৃদ্ধির হার কেন ৩.১%।এই সংকোচন যে সারা বছর ধরেই চলবে তার আভাস দিয়ে রেখেছেন অর্থনীতিবিদেরা।রাহুল গান্ধী থেকে অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন বার বার কেন্দ্রীয় সরকারকে গরীব মানুষদের জন্য ত্রানের ব্যবস্থা করার জন্য বলেছিলেন।যা না করার জন্যেই আজ দেশ বিপদে।ফিচ,গোল্ডমান স্যাক্সের মত মূল্যায়ন বা উপদেষ্টা সংস্থা তো এইবছরের জিডিপির সংকোচনের হার দুসংখ্যায় পৌঁছানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। মর্গান স্ত্যানলি নীতির অভাবের দিকে আঙুল তুলছে। পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতিগুলির মধ্যে ভারতের অবস্থা সবচেয়ে কাহিল হয়েছে এই নীতিহীনতার জন্যেই। অকর্মণ্য নিষ্কম্মা সরকার হলে আর কিই বা আশা করা যায়।বিষফলের বীজ পুঁতলে তো অমৃতফল লাভের আশা করা যায় না।

শুধুমাত্র এই বছরেই দেশের অর্থনীতি থেকে মুছে যেতে পারে অন্তত ১৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা।প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পু চিদাম্বরম বলেছেন ” গত এক বছরে দেশের জিডিপির চা ভাগের একভাগ কমে গেছে।বা গত অর্থবছরের শেষ থেকে জিডিপি প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে।”

তবে বিপর্যয়ের কারন হিসাবে করোনা মহামারীর ওপর চাপালে চলবে না। গত বছরের ত্রৈমাসিক বৃদ্ধিগুলিতে এই কমার হার নিয়মিত ঘটেছে। কোভিদ আসার আগে থেকেই লগ্নি কমেছিল, ভোগ্যপন্যের চাহিদা নিম্নমুখী এবং কর্মসংস্থানহীনতার হার গত ৫০ বছরে সর্ব্বোচ্চ হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ অর্থনীতিকে আগেই মেরে ফেলেছিলেন ঐ মোদী-সীতারমনরাই।মহামারীর ধাক্কা সামলাতে ব্যর্থ এই সরকার,লকডাউনের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করবার আগে কখনও ভাবেই নি যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ও অসংগঠিত শিল্পে তার কি প্রভাব পড়বে।দেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের কি অবস্থা হবে।তাই অন্তঃসারবিহীন প্রতিশ্রুতি যেমন পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি বা কৃষকের আয় দ্বিগুন করা – সব এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তবে এবারে এই অবস্থার দায় তারা অভ্যাসমত নেহেরুজির ওপর চাপান নি,চাপিয়েছেন ইশ্বরের ওপর।দেশের আর্থিক সিদ্ধান্ত যদি বিশেষজ্ঞদের বদলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ পারিষদের পরামর্শে ঠিক করা হয় তাহলে দেশ দিন দিন এভাবেই তলিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন : মহামারির জেরে ২০২০-২১ অর্থ বর্ষে দেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হবে বলে জানালো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক

Previous articleNCB জানতো না মাদক-কাণ্ডে বলিউডি যোগ ! প্রথম সারির ২৫ জনকে সমন পাঠাবে
Next articleBREAKING: হেমতাবাদের MLA আত্মহত্যাই করেছেন, চার্জশিট পেশ করলো CID