কৃষি বিল: কেন্দ্রের যুক্তি বনাম বিরোধিতার কারণ

 

কল্যাণকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

সংসদে কয়েকটি বিরোধী দল ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু শরিক দলের কড়া প্রতিরোধের মধ্যেই নরেন্দ্র মোদি সরকার রবিবার রাজ্যসভায় কৃষিক্ষেত্র সংক্রান্ত তিনটি বিল উপস্থাপন করেছে। রবিবার দুটি এবং মঙ্গলবার একটি বিল পাশও হয়ে গিয়েছে।
গত শুক্রবারই লোকসভায় এই তিনটি বিল পাশ হয়েছিল। সরকারের দাবি কৃষিপণ্যের বাণিজ্যের উদারিকরণই এই তিনটি বিলের লক্ষ্য। তবে প্রকৃতপক্ষে এই বিলগুলি কৃষি ব্যবস্থার পক্ষে একটি অভিশাপ ও কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানা, এজন্য বিরোধী দলগুলি এই তিনটি বিলের বিরোধিতা করছে।
চলুন একটু ব্যাখ্যা করা যাক।

*প্রথম বিল :* *কৃষিজাত পণ্য উত্পাদন ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার ও সুবিধাসমূহ ) বিল, 2020*

*সরকারের যুক্তি:*

প্রথম বিলটি কৃষি বাজার সংক্রান্ত। এই বিলে বলা হয়েছে এমন একটি বাস্তুতন্ত্র তৈরি করা হবে, যেখানে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা রাজ্যের কৃষি পণ্য বাজার কমিটির আওতায় অন্তর্ভুক্ত কৃষিমান্ডিগুলির বাইরে খামারজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন।।
রাজ্যের ভিতরে ও বাইরে কৃষি উৎপাদনের বাণিজ্য বাধামুক্ত হবে।

*বিরোধীদের যুক্তি :*

বিরোধী দলগুলি জানিয়েছে এই ব্যবস্থার ফলে রাজ্যগুলির রাজস্ব সংগ্রহে বড় ক্ষতি হবে। কারণ, কৃষকরা মান্ডিগুলির বাইরে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয শুরু করলে রাজ্য ‘ম্যান্ডি ফি’ পাবে না।
এছাড়া, তারা প্রশ্ন তুলেছে, যদি সম্পূর্ণ কৃষিবাণিজ্যই মান্ডির বাইরে চলে যায়, সেই ক্ষেত্রে রাজ্যের মান্ডি ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।।
সেই সঙ্গে এই বিল শেষ পর্যন্ত এমএসপি-ভিত্তিক অর্থাৎ ন্যুনতম সমর্থিত মূল্যের ক্রয় ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে।
ই-এনএএম অর্থাৎ সরকারি কৃষিপণ্য বিক্রয়ের অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মতো বৈদ্যুতিন বাণিজ্য সংস্থাগুলি কৃষি মান্ডিগুলির পরিকাঠামোই ব্যবহার করে। ব্যবসা বাণিজ্যের অভাবে যদি মান্ডিগুলিই ধ্বংস হয়ে যায় সেই প্ল্যাটফর্মগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে, এই ব্যাপারে কোনো উত্তর সরকারের কাছে নেই।

2. *দ্বিতীয় বিল :* *কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা) মূল্য আশ্বাস এবং খামার পরিষেবার চুক্তির বিল, ২০২০*

*সরকারের যুক্তি :*

এই বিলটি চুক্তিভিত্তিক চাষ সংক্রান্ত। এতে বলা হয়ছেে, কৃষকরা ভবিষ্যতের কৃষি পণ্য বিক্রির জন্য কৃষিবাণিজ্য সংস্থা, প্রক্রিয়াকারক সংস্থা, হোলসেলার, পাইকারি ব্যবসাদার, রফতানিকারক বা বড়মাপের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রাক-সম্মত মূল্যে চুক্তি করতে পারবেন।
এই চুক্তির মাধ্যমে পাঁচ হেক্টরের কম জমির মালিক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা লাভবান হবেন (ভারতের মোট কৃষকদের ৮৬ শতাংশই প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক)।
এতে করে অপ্রত্যাশিত বাজারের ঝুঁকি কৃষকদের কাঁধ থেকে তাদের স্পনসর সংস্থাগুলির কাঁধে স্থানান্তরিত হবে।

আরও পড়ুন-রাফাল চুক্তির শর্ত ভাঙছে ফরাসি সংস্থা দাসো, অভিযোগ সিএজি-র

*বিরোধিতার কারণ :*

চুক্তি চাষের ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের ক্ষতিই হবে। কারণ তারা চুক্তির অন্য পক্ষের মতো দরাদরি করার বিষয়ে দক্ষ নন, তাই তাদের প্রয়োজনটা আদা করতে পারবেন না।
টুকরো টুকরো করে বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করতে সম্ভবত স্পনসররা পছন্দ করবে না।
বড় বেসরকারী সংস্থাগুলিই হোক কিংবা রফতানিকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী বা প্রক্রিয়াকারকরা, বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ছোট কৃষকদের থেকে তারা অবশ্যই বেশি সুবিধা পাবে।

3. *তৃতীয় বিল :* *অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) বিল, ২০২০*

*সরকারের যুক্তি :*

এই বিলটি পণ্য সম্পর্কিত। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য়ের তালিকা থেকে খাদ্যশস্য, ডালশস্য, তৈলবীজ, পেঁয়াজ এবং আলু জাতীয় পণ্য সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে এই বিলে। যুদ্ধের মতো কোনও ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’ বাদে এই জাতীয় পণ্যগুলি মজুতে সীমা আরোপ করা হবে না।

*বিরোধিতার কারণ :*

বিরোধীদের বক্তব্য ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’র যে উদাহরণ সরকার দিয়েছে সেই রকম চরম পরিস্থিতি সম্ভবত কখনই তৈরি হবে না।
বড় সংস্থাগুলি পণ্য মজুদ করার স্বাধীনতা অর্জন করার অর্থ তারা কৃষকদের উপর শর্ত আরোপ করার সুযোগ পাবে। যার ফলে চাষীরা কৃষিপণ্যের কম মূল্য পেতে পারেন।
এই বিধান পেঁয়াজের রফতানি উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি করেছে।

Previous articleপ্রথম এশীয় মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার করেছিলেন কলকাতার আরতি
Next articleBig Breaking: সিবিএসই দ্বাদশের কম্পার্টমেন্ট পরীক্ষার ফল ১০ অক্টোবরের মধ্যে, আদালতে জানাল কেন্দ্রীয় বোর্ড