প্রথম এশীয় মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার করেছিলেন কলকাতার আরতি

মাত্র ১৯ বছর বয়সে ৬৭ কিলোমিটার সাঁতার কেটে পার করেছিলেন ইংলিশ চ্যানেল। ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিটের এক রুদ্ধশ্বাস পর্ব ছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে তেরঙে পতাকা উড়িয়ে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন ইংলিশ চ্যানেল পার করা প্রথম এশীয় মহিলা আরতি সাহা।

‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত আরতি সাহাকে দিনের পর দিন লড়াই করে যেতে হয়েছে তাঁর নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য। ভারতীয় মহিলা হিসেবে কার এই অভিযানে যাওয়া সম্ভব, নাম জানতে চাওয়া হলে উঠে আসে আরতি সাহার নাম। নামটি সুপারিশ করেন পূর্ব পাকিস্তানের সাঁতারু ব্রজেন দাস। তিনি ১৯৫৮-৬১ সালের মধ্যে মোট ছ’বার ইংলিশ চ্যানেল পারাপার করেছিলেন। আরতি সাহা তখন গোটা পৃথিবীর কাছে বেশ একটি পরিচিত নাম। কিন্তু শুধু নামে কী হয়? টাকারও দরকার পরে। প্রয়োজন ছিল কুড়ি হাজার টাকার। যা তাঁর কাছে ছিল না। প্রতিদিন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা অনুশীলনের পর চাকরি, তারপর টাকার জন্য ঘুরে বেরিয়ে রোজ খালি হাতে বাড়ি ফেরা। এই ছিল নিত্য দিনের ঘটনা।

সেই সময় আরতি সাহাকে আর্থিক সাহায্যের জন্য একটি পথ বাতলেছিলেন অল ইন্ডিয়া স্পোর্টস কাউন্সিল-এর সদস্য পঙ্কজ গুপ্ত। তিনি আরতি’কে পাঠিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়’এর কাছে। আরতি সাহা’র মুখে চ্যানেল পার করার কথা শুনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “ইংলিশ চ্যানেল চোখে দেখেছ! পার হওয়ার কথা বলছ?” এরপরেই আরতির মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করেছিলেন তাঁকে। বলেছিলেন,”সকালে টাকা বাড়িতে পোঁছে যাবে। হাসি মুখে ফিরতে পারবে তো মা?”। এরপর আর্থিক সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন জওহরলাল নেহেরু, মিহির সেন, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, সমাজসেবী শম্ভুনাথ মুখোপাধ্যায়, অতুল্য ঘোষ ও চিকিৎসক অরুণ গুপ্ত।

আরও পড়ুন : হাত ধোয়ার কথা বলাতে যে চিকিৎসককে ‘পাগল’ বলেছিল দুনিয়া, গুগল জানালো সম্মান

২৭ অগাস্ট ১৯৫৯ ব্যর্থ হন আরতি সাহা। অভিযানের শুরুতেই সমস্যা। নেভিগেশন বোট আসতে চল্লিশ মিনিট দেরি করে। ১৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতার কাটার পরেই বোট্ম্যান ঘুরপথে নিয়ে গেলেই বিপদের মুখে পড়েন আরতি। স্রোতের বিপরীতে পড়ে যান তিনি। তিনি আর এগোতে পারছেননা দেখে বোটম্যান তাঁকে ছুয়ে দেন। আর নিয়ম অনুযায়ী, সাঁতারুকে কেউ স্পর্শ করলে বাতিল হয়ে যান তিনি। তখন গন্তব্যে পৌঁছতে আর মাত্র তিন মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে। তাঁর পাশে তখন সাঁতার কাটছে ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের সোনাজয়ী সাঁতারু গ্রেটা অ্যান্ডারসন।

ফের এলো সাফল্যের দিন ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার করলেন আরতি সাহা। ফ্রান্সের কেপ গ্রিস নেজ থেকে ইংল্যান্ডের স্যান্ডগেট। ক্যাপ্টেন হার্টিনসন গাইড হিসেবে প্রথম কোনও মহিলাকে পথ দেখাচ্ছিলেন।

আজ গুগল ডুডল আরতি সাহা’র ৮০তম জন্মদিন উদযাপন করেছে। তাঁর জন্ম ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪০ সালে কলকাতায়। খুব ছোট থেকে তাঁর সাঁতারের প্রতি ঝোঁক ছিল। তাঁর জীবনে সাঁতারের প্রথম অনুশীলন ছিল হুগলি নদীতে। ১৯৪৫-৫১ সালে মাত্র চার থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ২২ টি স্টেট লেভেলের টাইটেল জিতেছিলেন। ১৯৫২ সালে অলিম্পিক গেমসে তিনি ভারতকে রিপ্রেসেন্ট করেছিলেন। ১৯৬০ সালে ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হন। কিন্তু কোনও মেডেল জেতেননি। তিনি মিহির সেনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যিনি প্রথম এশীয় পুরুষ হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পারাপার করেছিলেন। পরবর্তী সময় মিহির সেন ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।

ইংলিশ চ্যানেল পার করা মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণের সমান। এই দৌড়ে ছিলনে কমপক্ষে আট জন সাঁতারু। দীর্ঘ কয়েকটা মাস ধরে আরতি সাহা শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অবশেষে ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯-এ তিনি পার করে ফেলেছিলেন ইংলিশ চ্যানেল।

মাত্র আড়াই বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন আরতি। বাবা পাচুগোপাল সাহা সেনা বিভগে চাকরি করতেন। সময় দিতে পারতেন না মেয়েকে। তাঁর ছোট থেকে বড়ো হয়ে ওঠা উত্তর কলকাতার সাহা বাড়িতে, ঠাকুমার কাছে। তাঁর কাকা বিশ্বনাথ সাহা তাঁকে হাটখোলা সুইমিং ক্লাবে ভর্তি করে দেন। ঠিক এক বছর পর শৈলেন্দ্র মেমোরিয়াল সাঁতার প্রতিযোগীতায় ১১০ গজ ফ্রি স্টাইলে প্রথম হন তিনি। স্বর্ণজয়ী সাঁতারু শচিন নাগ ছিলেন তাঁর গুরু। আসতে আসতে বিদেশের মাটিতেও নাম ছড়িয়ে পরে তাঁর। ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে সাঁতারু ডলি নাজিরের সঙ্গে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন আরতি সাহা।

সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন আরতি। এরপর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসক অরুণ গুপ্তের সঙ্গে বিয়ে হয় আরতির। সেই সময় তিনি দক্ষিণ পূর্ব রেলে চাকরি করতেন ১৪২.৫০ টাকা মাস মাইনেতে।

১৯৯৪ সালে ২৩ অগাস্ট মাত্র ৫৪ বছর বয়সে জন্ডিস ও এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।

১৯৯৯: তিন টাকা মূল্যের ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয় আরতি সাহার নামে।

আরও পড়ুন : করোনা-‘যোদ্ধাদের’ আরও একবার অভিবাদন জানালো গুগল

Previous articleদেবানন্দ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট গ্রহণ পুলিশের
Next articleকৃষি বিল: কেন্দ্রের যুক্তি বনাম বিরোধিতার কারণ