বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘কালের কন্ঠ’৷ সেই কাগজের নয়াদিল্লির বিশেষ প্রতিনিধি জয়ন্ত ঘোষাল৷ ঘটনাচক্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসারও জয়ন্তবাবু৷ কিছুদিন আগে জয়ন্ত ঘোষালকে রাজধানীতে এ রাজ্যের ‘ইনফরমেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ করেছে নবান্ন।

‘কালের কন্ঠ’ পত্রিকায় ২ নভেম্বর, সোমবার
জয়ন্ত ঘোষাল লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভারতনীতিতে আচমকা কোনো পরিবর্তন হবে না’৷ এর কারন ব্যাখ্যা করে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির, তাঁর আন্তরিকতার, তাঁর পররাষ্ট্র নীতির, তাঁর ‘মোকাবিলা’ করার দক্ষতার৷ আর এর পরই রাজ্য এবং রাজধানীতে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- সরকারের একজন অফিসার এভাবে খোলাখুলি নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করা নিয়ে৷

দিল্লির ‘পাওয়ার- করিডোর’ খুব কাছ থেকে দেখা অভিজ্ঞ সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল ভারত- মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে তাঁর অনেক পুরনো সুখস্মৃতি এই প্রতিবেদনে সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন৷ অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে, বিশেষত আমেরিকার সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ বজায় রাখার প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদির নিজস্ব চিন্তা- ভাবনাপ্রসূত বিদেশনীতি যে তাঁর পূর্বসূরীদের থেকে অনেক বেশি দেশের স্বার্থযুক্ত, তা বোঝাতে এই প্রতিবেদনে জয়ন্ত ঘোষাল লিখেছেন, “মনমোহন সিংয়ের একটা সমস্যা ছিল, যেটা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মনমোহন সিংয়ের একটা বিরাট চারিত্রিক তফাত। সেটা হলো বিভিন্ন বিষয়ে সংশয়। অর্থাৎ করব কী করব না। কতটা করব। কতটা করব না। নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রে কিন্তু চিন্তার স্বচ্ছতা অনেক বেশি। অর্থাৎ সেটা ঠিক হোক বা ভুল হোক, যেটা তিনি উচিত মনে করছেন, সেটা করেছেন। যেমন, প্রথমত একটা সামরিক সংকট চিনের উত্তর সীমান্তে তৈরি হয়েছে। গত ছয় মাস ধরে চলছে। মনমোহন সিং সেই সমস্যাটাকে পরিহার করেছিলেন অনেকটাই আপসের মনোভাব নিয়ে। বেইজিংয়ের সঙ্গে একটা বুঝে নেওয়ার মানসিকতা কিন্তু ছিল না। মোদি সরকার যেটা করেছে, তারা কিন্তু চিনের এই নিরাপত্তার হুমকি ধামাচাপা না দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছে। ভারতও তার পেশি প্রদর্শন করার চেষ্টা করেছে। সেখানে আমেরিকার সঙ্গে তাদের সহযোগিতার রণকৌশলটা আরো এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেটা নিয়ে কোনো দ্বিধা রাখেনি।”

প্রধানমন্ত্রীর সামগ্রিক দক্ষতাকে সমর্থন করে বলা হয়েছে, “প্রতিরক্ষা খাতে, বিশেষ করে উত্তর- পূর্বাঞ্চলে চিনের যে ড্রাগনের নিঃশ্বাস সেটাকে প্রতিহত করার জন্য প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারতের দুর্বলতা ছিল, মনমোহন সিংয়ের সময় যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছিল, সেই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে তোলার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার যথেষ্ট তৎপর এবং অস্ত্র বেশ কিছু কেনার ক্ষেত্রে অনেকটা বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সখ্য দীর্ঘস্থায়ী করতে নরেন্দ্র মোদিই যে কার্যত পথিকৃৎ, তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প ও ট্রাম্পহীন আমেরিকা, দুটির মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক তফাত রয়েছে। কেননা ট্রাম্প একটা নতুন আখ্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তৈরি করেছেন। ঠিক যে রকম নরেন্দ্র মোদি ভারতেও কিন্তু একটা নতুন আখ্যান তৈরি করেছেন।”

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “১৯৯১ সালে আর্থিক উদারবাদ যখন এলো, তখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়। কিন্তু যেটা নরেন্দ্র মোদি করেছেন, সেটা চিনের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, চিনের যে অভিসন্ধি সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে তিনি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। পাশাপাশি চিনের আগ্রাসনের প্রতিবাদে তিনি কিন্তু আপসের পথ এখনো নিতে রাজি নন।”

আরও পড়ুন: ৫০% যাত্রী নিয়ে চলতে পারে ট্রেন, ফের ‘লোকাল’ বৈঠক ৫ তারিখ: মুখ্যসচিব

আরও বলা হয়েছে, “এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এখন আমাদের দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কটা দ্বিপক্ষীয় যে বাণিজ্য শুধু নয়, নিরাপত্তার জন্যও সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যথেষ্ট জরুরি এবং সেটা নরেন্দ্র মোদি করছেন। সুতরাং অতীতে যদি কিছু ভুল হয়েও থাকে, এখন এই মুহূর্তে চিনের সঙ্গে আচমকা আবার বন্ধুত্ব করার পথও কিন্তু সোজা নয় এবং এখানে নরেন্দ্র মোদি সরকার বারবার বলছে, আমরা ঝগড়া করতে চাইনি।”

এদিকে, ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষত, পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত- মার্কিন সম্পর্কের প্রশংসা করতে গিয়ে প্রতিবেদক এককভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সঠিক পদক্ষেপ’,’দৃঢ়তা’, ‘স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি’-কেই বিনা কারনেই ফুল মার্কস দিয়েছেন বলে রাজনৈতিক মহলের ধারনা৷ বিজেপি-বিরোধী রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সরকারি অফিসারের এমন দৃষ্টিভঙ্গি কতখানি যুক্তিসঙ্গত হয়েছে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে৷

অবশ্য এটাও ঠিক, পেশাগত জীবনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জয়ন্ত ঘোষালের সম্পর্ক এতটাই স্বাভাবিক এবং স্বছন্দ, যে সব দলই ওনাকে তাদের ‘বন্ধু বা শুভাকাঙ্খী’ ভাবে৷ ফলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জয়ন্ত ঘোষালকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করলেও, বিজেপি-সহ প্রায় সব দলই মনে করেছে, ‘আমাদের একজন হিতৈষীকে’ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওজনদার দায়িত্ব দিয়েছে৷ জয়ন্তবাবুর পেশাগত সাফল্য এটাই৷ সব দলই তাঁকে ‘নিজের লোক’ ভাবে, এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই৷ সেদিক থেকে বিচার করলে তৃণমূলের এক ‘কাছের লোক’-কে বড় দায়িত্ব দেওয়ার পর বিজেপিও ভেবেছে তাদের অন্যতম একজন ‘কাছের লোক’ দিল্লিতে ‘শত্রু’ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন৷

জয়ন্ত ঘোষালের সাফল্য এখানেই৷
