শীর্ষ নেতৃত্বই বোঝাচ্ছেন বঙ্গ-বিজেপি নেহাতই ‘দুধে ভাতে’: কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

ছোটবেলায় বড়দের সঙ্গে ফুটবল খেলার সময় বড়রা বলতো, তুই যখন খেলতেই চাইছিস, যা তুই দুধেভাতে। এমন ‘দুধে ভাতে’ প্লেয়ার হওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে৷ কিন্তু আমি ভাবতাম, হোক না দুধে ভাতে, না থাক অভিজ্ঞতা, বড়দের সঙ্গে খেলতে তো পারবো ! বড়রা বলতো, তুই যেদিকে ইচ্ছা বল মার , তোর জন্য খেলার কোন নিয়ম নেই৷ পরে বুঝেছি, এই যেদিকে ইচ্ছা বল মারার অধিকারটাই ছিলো

দুধেভাতে-প্লেয়ারের বিরাট স্বাধীনতা৷

রেগে গেলে কিছুই করার নেই, একুশের ভোটে বাংলার রাজনৈতিক স্টেডিয়ামে বঙ্গ-বিজেপি এমনই ‘দুধে ভাতে’ প্লেয়ার৷ বিরোধীরা নন, দলের ‘বড়’রাই বঙ্গ-বিজেপির নেতাদের মাথায় যেনএই ‘দুধে-ভাতে’ তকমা সাঁটিয়ে দিয়েছেন৷ আর এই ‘বড়’- দের মাথায় আছেন খোদ অমিত শাহ৷ বাংলায় দলের নেতাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন খোদ শাহজিই৷

একুশের ভোটে বিজেপি বাংলা ‘দখলে’ মরিয়া হয়ে নেমে পড়েছে৷ নেমেছে বটে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজেই রাজ্য বিজেপির নেতাদের উপর ন্যূনতম ভরসাও রাখতে পারছেনা দিল্লির বিজেপি৷ এই খামতি ঢাকতে ভিন রাজ্য থেকে দলে দলে গেরুয়া নেতা ঢুকছে বাংলায়৷ শাহজির আশা, তাঁর এই টিমই বিজেপিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে à§·

ঠিক এমনভাবেই অমিত শাহ ছক সাজিয়েছিলেন দিল্লির ভোটে৷ দিল্লি-বিজেপি ওই ভোটে ছিলো নেহাতই দুধে-ভাতে৷ প্রধানমন্ত্রী তো ছিলেনই, এছাড়াও প্রায় সব ক’জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপি শাসিত সবক’টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী-বাহিনী, সব রাজ্য থেকে বাছাই করা হাজার দুয়েক বড়- মেজো-ছোট নেতায় কিলবিল করেছিলো দিল্লির ভোট৷ স্বয়ং অমিত শাহকে দেখা গিয়েছিলো মহল্লা মহল্লায় পদযাত্রা করে লিফলেট বিলি করতে৷ ভিন রাজ্য থেকে আনা গেরুয়া নেতাদের তৈরি করা জনারণ্যে হারিয়ে গিয়েছিলো দিল্লি প্রদেশ বিজেপি৷ দলের শীর্ষ নেতারা বসে যান মুখ্যমন্ত্রী বাছতে৷

আর ফলাফল প্রকাশের পর কী হয়েছে, তা আজ আর কারো অজানা নয়৷ ‘এক্সপোর্ট- কোয়ালিটি’-র ভোট-বিশেষজ্ঞরা হাওয়া হয়ে গেলেন৷ কোপ পড়লো দিল্লি-বিজেপির সভাপতি মনোজ তিওয়ারির ঘাড়ে৷ অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে এখানে-ওখানে প্রচারমঞ্চে উঠে ভোজপুরি গান-সহযোগে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া গোটা নির্বাচন পর্বে পাতা নড়ানোর ক্ষমতাটুকুও তাঁর ছিলোনা৷ অথচ ফলপ্রকাশের দু’দিনের মধ্যেই ‘ব্যর্থ-অদক্ষ-অযোগ্য’ ছাপ্পা লাগিয়ে দিল্লি-বিজেপির সভাপতির পদ থেকে তাড়ানো হলো মনোজ তিওয়ারিকে৷ বেচারা শুধু ‘মুখ্যমন্ত্রী হবেন’ এমন স্বপ্ন দেখে যাওয়া ছাড়া গোটা ভোটে ভালো বা খারাপ, কিছুই করার চান্স পেলেন না, অথচ শূলে চড়ানো হলো তাঁকেই৷

বাংলার ভোটের ফল কী হবে, তা জানা যাবে ফলপ্রকাশের পর৷ কিন্তু নজির যখন আছে, তখন এমন ‘আশঙ্কা’ও তো অস্বীকার করা যাচ্ছেনা৷

দেশের রাজনীতিতে এখন বিজেপির রমরমা। রাজ্যসভাতেও শক্তি বাড়িয়েছে গেরুয়া শিবির৷ জাতীয়স্তরে কংগ্রেস ক্রমশ ছোট দলে পরিনত হচ্ছে৷ দখলে না থাকা
রাজ্য দখলে আনতে মরিয়া বিজেপি। বিহারের পর এখন তাদের লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ৷ রণকৌশল তৈরি করে বাংলা দখলে ঝাঁপিয়েও পড়েছে বিজেপি।

কী সেই রণকৌশল ?

বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ভিন রাজ্য থেকে একগাদা নেতাকে হাজির করেছেন বাংলায়। এই নেতারা কে কোথায় দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনবেন, সেই এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। শীর্ষ নেতারা সম্ভবত বুঝেছেন, বিধানসভা ভোটে দলকে জিতিয়ে আনার দক্ষতা বঙ্গ- নেতাদের নেই৷ তাই,
◾ বাংলার ভোট সামলাবেন সুনীল দেওধর, বিনোদ তাওড়ে, বিনোদ সোনকর, দুষ্যন্ত গৌতম এবং হরিশ দ্বিবেদীরা। রাজ্যকে পাঁচ সাংগঠনিক জোনে ভাগ করে এই পাঁচ নেতাকে ‘সুপ্রিম’ আসন দেওয়া হয়েছে৷ হাওড়া, হুগলি ও মেদিনীপুর জোনের দায়িত্বে থাকবেন সুনীল দেওধর। রাঢ়বঙ্গ-জোনের দায়িত্বে থাকবেন বিনোদ সোনকর। দুষ্মন্ত গৌতমকলকাতা জোনের দায়িত্বে৷ নবদ্বীপ জোনের দায়িত্বে বিনোদ তাওরে আর উত্তরবঙ্গ জোনের দায়িত্বে থাকছেন হরিশ দ্বিবেদী।
বাংলা-বিজেপি আগেই এই পাঁচ সাংগঠনিক জোনে ৫জন রাজ্য নেতাকে পর্যবেক্ষক করেছেন৷ কিন্তু ৫ কেন্দ্রীয় নেতাকে মাথায় বসানোয়, রাজ্যের ওই ৫ পর্যবেক্ষকের কাজ কী হবে, তাঁরাও এর উত্তর খুঁজছেন৷

◾দিল্লি জানিয়েছে, আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জেলা কমিটিগুলির মাথায় একজন করে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক বসানো হবে৷ বসানোর পরদিন থেকে জেলা সভাপতিরা ঠিক কী করবেন, উত্তর খুঁজছেন৷

◾শীর্ষ-বিজেপি বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, বাংলার ভোটে ‘বুথ কন্ট্রোলার’ নামে একটি পদ তৈরি হচ্ছে৷ সেই পদে আনা হচ্ছে সুনীল বনশলকে৷ এই বনশল এখন উত্তর প্রদেশ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক à§· তাঁর অধীনেই রয়েছে যোগীর রাজ্যের ১লক্ষ ৮৪ হাজার বুথ৷ বনশল নাকি পিছনে থেকে বুথস্তরে ছোট ছোট রণনীতি তৈরি করতে অতীব দক্ষ à§· কলকাতা-সহ যে সব জেলায় লোকসভা ভোটে বিজেপি পিছিয়ে ছিলো, মূলত সেই সব জেলার বুথগুলির দেখভাল করবেন সুনীল বনশল৷ রাজ্যের দুর্বল জেলাগুলিতে ম্যাজিক দেখাতে অমিত শাহের হাতিয়ার বনশল৷ ডিসেম্বরের শুরুতেই বাংলায় চলে আসছেন সুনীল বনশল৷

◾গোটা দেশে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা প্রায় ১২০০, সাংসদও ৪০০-র কাছাকাছি৷ এই বিশাল বাহিনীকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাংলায় আনা হবে৷ দেওয়া হবে নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব৷ গ্রাউণ্ড-লেভেলের কাজের তদারকি করতেই এই সাংসদ-বিধায়কদের রাজ্যে আনা হচ্ছে৷

◾এছাড়া কৈলাস বিজয়বর্গী, অরবিন্দ মেনন, অমিত মালব্য তো আছেনই৷

◾এবং জানানো হয়েছে ভোট পর্যন্ত প্রতি মাসেই বেশ কয়েকদিন করে বাংলায় থাকবেন অমিত শাহ এবং জে পি নাড্ডা৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাজ্যে থাকবেন একাধিক হেভিওয়েট কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দলও৷

বাংলা দখল করতে বিজেপির শীর্ষমহল আপাতত যে ছক সাজিয়েছে, তাতে ভোট-পর্বের চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিক হিসাবেই থাকবেন বঙ্গ-বিজেপির নেতারা৷ দলের টিকিট দেওয়া থেকে প্রচার কৌশল, বুথস্তরের স্ট্র্যাটেজি থেকে কোন এলাকায় কোন স্টার-ক্যাম্পেনার যাবেন, সব চলে গিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে, একেবারে দিল্লি ভোটের স্টাইলে৷ ভোটপর্বে রাজ্যের ‘অসহায়’ নেতাদের কাজ কী হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি৷ সেটাও বলে দেবে দিল্লি৷

মোটের উপর, বিজেপির শীর্ষ নেতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন এ রাজ্যের নেতাদের দক্ষতার ওপর তাঁদের বিন্দুমাত্রও ভরসা নেই। অথচ “কেন এমন হচ্ছে?” এ কথা বলার জায়গায় নেই রাজ্য বিজেপির ‘হেভিওয়েট’ নেতারা৷ আত্মমর্যাদা ভুলে এই সুরেই গান গাইতে হবে তাঁদের৷

আরও পড়ুন:বিজেপিকে রুখতে মহাজোটের ডাক আব্বাসের, ক্ষমতায় তৃণমূলই: মত ত্বহার

ছোটবেলায় খেলতে গেলে বড়রা বলতো, “তুই যেদিকে ইচ্ছা বল মার, তোর জন্য খেলার কোন নিয়ম নেই”à§· এই যেদিকে ইচ্ছা বল মারার অধিকারই দুধেভাতে- প্লেয়ারের বিরাট স্বাধীনতা৷ বঙ্গ-নেতাদের ছোটবেলার ‘দুধেভাতে’ প্লেয়ারদের ভূমিকাই না পালন করতে হয়৷

আর এই সময় বঙ্গ- বিজেপিকে শুধু মাথায় রাখতে হবে দিল্লির মনোজ তিওয়ারির নাম এবং ফলপ্রকাশের পর মনোজবাবুর কী হয়েছিলো, সেইসব কথা৷ ব্যস !