মহুয়ার মন্তব্য খারাপ, কিন্তু মিডিয়াকেও আয়নায় মুখ দেখতে হবে: কুণাল ঘোষের কলম

“দু পয়সার সাংবাদিক”।
বিতর্কে মহুয়া মৈত্রর বাক্যটি।

এটি প্রতিবাদযোগ্য। নিন্দনীয়। আমিও প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করেছি। এই কথা বলা মহুয়ার ঠিক হয়নি। সাংবাদিকতা বা সাংবাদিকদের এভাবে সামগ্রিক চেহারায় অসম্মান করা যায় না। যেতে পারে না। এটা নিয়ে জেদাজেদি না করে মহুয়ার উচিত দুঃখপ্রকাশ করে মিটিয়ে নেওয়া।

এই জায়গাতে আমি স্পষ্টভাবেই প্রতিবাদী। সাংবাদিকদের লড়াই, ত্যাগ, অনিশ্চয়তা, আবেগকে অসম্মান করা অন্যায়।

কিন্তু এটাও বলব মিডিয়াও আয়নায় মুখ দেখুক।
আগেকার সেই আবেগঘন ফ্রিল্যান্সিং, সাধনা, সীমিত মিডিয়ায় স্থান পাওয়ার দৌড় আজকের ফোন- সাংবাদিকতায় শুরুতেই স্বাধীন পাণ্ডিত্য ফলানোর প্রযুক্তিগত সুবিধায় সব ইতিবাচক হচ্ছে তো?

আগে তরুণ রিপোর্টার একটি কপি জমা দিলে বর্ষীয়ান চিফ রিপোর্টার যতবার নাক কুঁচকে সত্যতা যাচাই করে তরুণটিকে জেরবার করতেন; আজ তা কার্যত অতীত।

আজ খবরের চরিত্রকে ফোন করার বদলে “গুঞ্জন” দিয়েই ব্রেকিং নিউজ হয়। কী অপূর্ব গর্বে পর্দার পণ্ডিত খবর বলে চালানোর পর নিজেই বলেন, ” এটা অবশ্য গুঞ্জন।”

হাতে ফোন। প্রযুক্তি ছড়াচ্ছে। সাংবাদিকতার নামে নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দেওয়ার অবাধ গণতন্ত্র। হাউস নেই, কর্মী নেই, টিম নেই, শুধু আমি কী ভাবছি? যত সরকারবিরোধী, তত প্রচার। স্পেশাল স্টোরি, জেলার স্টোরি, মানুষের স্টোরি, ভালো বাংলা- এসব অপ্রয়োজনীয়। এখন চটকদার গালমন্দের যুগ। এখন কৃষক আন্দোলন বা পরিযায়ী শ্রমিকের থেকে গুরুত্ব পায় অন্তঃসত্ত্বা অনুষ্কা, করিনা, শুভশ্রীর ছবি। আর ব্যক্তিবিপ্লবীদের ধারাভাষ্যে শুধু রাজনীতির নির্দিষ্ট লাইনে ব্যক্তি আক্রমণ। সাংবাদিকতায় কত যুগ ধরে কত রকম খবর করা যায়, পরীক্ষা হল কই? দরকারই বা কী! হাতের ফোনে তো ক্যামেরা।

মূলস্রোতের মিডিয়াও অনুমানযোগ্য। কোন্ চ্যানেল বা কাগজ কোন্ ইস্যুতে কী বলবে, জানা কথা। কেন্দ্র বা রাজ্য, বিজ্ঞাপন দিলে এক। না দিলে আরেক। সব প্রেডিক্টেবল।

যে মিডিয়া চিট ফাণ্ডের বিজ্ঞাপনে ভরে থাকত, তারাই বিপ্লবী ! তার উপর মিডিয়ার নিজস্ব ঈর্ষা, গোষ্ঠীবাজি, পরশ্রীকাতরতা, অসভ্যতা লেগেই আছে। কাক এখানে কাকেরই মাংস খায়। পারফরমেন্সে পিছিয়ে পড়ারা হিংসা বিষ ঢালে মানসিক অবসাদে।

এর মধ্যে কিছু ছেলেমেয়ে এখনও খেলাটাকে ভালোবেসে লড়ছে। তাতে কোনো ফাঁক নেই। এর মধ্যেই হাউস গড়ার স্বপ্ন দেখা চলছে। তাতে কোনো খাদ নেই। কিন্তু সিস্টেমটায় গলদ ঢুকেছে, এটা বাস্তব।

মিডিয়ার টিকি বাঁধা বিজ্ঞাপনদাতার কাছে, সরকার হোক বা শিল্পগোষ্ঠী। মিডিয়ার লোকেদেরও সংসার চালাতে হয়। মিডিয়াকেও বাধ্যবাধকতায় আপোস করতে হয়।

এক মিডিয়া আরেক মিডিয়ার প্রতিপক্ষ।
আবার এক মিডিয়ার ঘরের মধ্যেও তো গোষ্ঠীবাজি। নিজের জায়গা রাখার লড়াই। হঠাও প্রতিদ্বন্দ্বী। জীবনের আদি অকৃত্রিম লড়াই। সব পেশার লড়াই। এখানেও। সেটাও বহু জায়গায় কুরুচিকর অবস্থায় যাচ্ছে।

এখনও মিডিয়ার একটি ছোট অংশ আর্থিক সুরক্ষা বেষ্টনীতে। জেলায় জেলায় এবং শহরেও বড় অংশই বহুরকম অনিশ্চয়তায়। ছাঁটাই, বন্ধ, বেতন সংকোচন চলছে। কোনো সম্মিলিত প্রতিবাদ নেই। যে দু একজন সাংবাদিক এগুলোয় জোর দিতেন তাঁরা দশচক্রে ভগবান ভূত। ফলে অসহায়তা প্রবল।

প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা ভাঙছে। প্রযুক্তিপ্রবাহে ব্যক্তিসংলাপের প্রবণতা বাড়ছে। এর মধ্যে নানা সংলাপ। নানা সাফল্য। নানা অভিযোগ। সবচেয়ে বড় কথা গুণগত মানে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি। মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর পরিবেশন। বড় হাউসের বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতার ব্যক্তিসংস্করণের প্রবণতা। তাতে সাংবাদিকতার মোড়ক থাকলেও তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু থাকছে। এবং সময়ের পরীক্ষা দেওয়া বাকি।

আরও পড়ুন:“দুঃখপ্রকাশ করলে মানুষ ছোট হন না”, মহুয়া প্রসঙ্গে রুদ্রনীল

এহেন পরিস্থিতিতে মহুয়ার কথার আমি তীব্র প্রতিবাদ করবই। সামগ্রিকঅর্থে ঐ শব্দ ব্যবহার অনুচিত। আবার এটাও বলব, মিডিয়া একটু অন্তত আত্মসমালোচনা করুক। কাল দুপুরে আমার সংক্ষিপ্ত পোস্টে বেশি লেখার সময় সুযোগ ছিল না। মহুয়া নিয়ে এত ফোন আসছিল, প্রতিবাদটা অগ্রাধিকার ছিল। কিন্তু যদি বাকি অংশটা না লিখি তাহলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বিষয়টি।

Previous articleকুয়াশার চাদরে ঢেকেছে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা, ট্রেন ও বিমান পরিষেবায় বিঘ্ন
Next articleমারাদোনা শোক কাটার আগেই এবার প্রয়াত মেসিদের বিশ্বকাপ ফাইনালে তোলা কোচ সাবেয়া