‘টার্মিনাল ম্যান’, একাধিক দেশের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে ১৮ বছর কাটিয়েছেন বিমান বন্দরে

দুর্দশা বোধহয় একেই বলে। দেশের শাসকের বিরুদ্ধে সরব হয়ে দেশছাড়া হওয়ার পর পৃথিবীর কোনও দেশে ঠাঁই পাননি তিনি। ঠাঁই অবশ্য মিলেছিল, বিমানবন্দরের একটুকরো কোণ। আর সেখানেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ১৮ টি বছর। পরে অবশ্য বিশ্বের একাধিক দেশ তাঁকে নাগরিকত্ব(citizenship) দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে আস্ত একটি সিনেমা, প্রকাশিত হয়েছে আত্মজীবনী ‘টার্মিনাল ম্যান'(Terminal Man)।

গোটা বিশ্বের নজর কেড়ে নেওয়া হতভাগ্য এই ব্যক্তির নাম মেহরান করিমি নাসেরি(Mehran Karimi Nassary)। অবশ্য স্যার আলফ্রেড মেহরান নামেই বেশি পরিচিত তিনি। জীবনে ১৮টি বছর বিমানবন্দরে কাটানোর পর আরও একটি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন একদা ইরানের বাসিন্দা মেহরান। লোকে তাকে বলতো ‘টার্মিনাল ম্যান’। জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ২৬ অগস্ট থেকে ২০০৬ সালের জুলাই পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সের শার্লে দি গৌলে বিমানবন্দরে(airport) থেকেছেন। থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা সব কিছুরই সঙ্গী ছিল এই বিমানবন্দর। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মামলা হয় যদিও অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত ওই জায়গা থেকে কেউ তাকে সরাতে পারেনি।

আরও পড়ুন:ইসরোর বিজ্ঞানীর চাঞ্চল্যকর অভিযোগ: খাবারে বিষ, ঘরে সাপ!

তথ্য অনুযায়ী, ইরানে জন্ম মেহরানে। তার বাবা পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। মা স্কটল্যান্ডের পেশাগতভাবে তিনি একজন নার্স। ১৯৭৭ সালে ইরানের শেষ রাজা মোহম্মদ রেজা শাহের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার কারণে ইরান থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয় বলে দাবি করেন তিনি। এরপর পৃথিবীর একাধিক দেশে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন, যদিও সে আবেদনে সাড়া দেয়নি কেউ। সবশেষে বেলজিয়ামের ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজি তাঁকে উদ্বাস্তু তকমা দেয়। এই তকমার জেরে একটি সুবিধা হয়ে যায় মেহরান। ইউরোপের একাধিক দেশে ঢোকার অনুমতি পেয়ে যান তিনি। ফলস্বরূপ জীবনের শেষ সময়টা ইংল্যান্ডের কাটানোর জন্য মনস্থির করেন ওই ব্যক্তি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে অবশ্য পুরনো যোগ ছিল তার। উচ্চশিক্ষার জন্য দীর্ঘ বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন তিনি। তবে সমস্যা বাঁধে সেখানেও।

১৯৮৮ সালে ফ্রান্স থেকে লন্ডনে যাওয়ার বিমান ধরেন তিনি। তবে লন্ডনে নামার পর চেকিংয়ের সময় নিজের পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেখাতে পারেননি মেহরান। ফলস্বরূপ লন্ডন থেকে ফের ফ্রান্সে ফেরত পাঠানো হয় তাঁকে। ফ্রান্সের পা রাখার পর পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে। তিনি দাবি করেন লন্ডনে বিমান ধরার সময় তার ব্যাগ চুরি হয় সেখানে পাসপোর্টসহ সমস্ত নথিপত্র ছিল। বিমানবন্দরের রেকর্ড দেখে জানা যায় সত্যিই তিনি লন্ডনের সময় নিজের পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়েছিলেন। ফলে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। সবকিছু হারিয়ে ফ্রান্সের বিমান বন্দরের এক নম্বর টার্মিনাল তখন হয়ে ওঠে তার ঘর বাড়ি। তাকে অবশ্য সেখান থেকে সরানোর চেষ্টায় কোনও কশুর করেনি সরকার। আদালতে দায়ের হয় মামলা। আদালত অবশ্য জানিয়ে দেয় বেআইনিভাবে বিমান বন্দরে প্রবেশ করেননি মেহরান। এরপর থেকে টানা ১৮ বছর সেখানেই কাটিয়েছেন তিনি। খাওয়া-দাওয়া, থাকা, গল্প-গুজব সবটাই চলত বিমানবন্দরের কর্মীদের সঙ্গে। লন্ডনে থাকবেন ভেবে একটা সময় নিজের নাম পরিবর্তন করে করেছিলেন স্যার আলফ্রেড মেহরান। পরে বেলজিয়াম ও ফ্রান্স তাঁকে নাগরিকত্ব দিতে চাইলেও সে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি তিনি।

এরপর ২০০৬ সালে বিমানবন্দরে অসুস্থ হয়ে পড়েন মেহরান। দ্রুত তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। একই সঙ্গে বিমানবন্দরে যেখানে তিনি থাকতেন ভেঙে ফেলা হয় সেই জায়গা। থেকে তার দায়িত্ব নেয় ফ্রান্সের রেড ক্রস। ছাড়া পাওয়ার পর কিছুদিন বিমানবন্দর লাগোয়া একটি হোটেলে রাখা হয় তাকে। পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অভিবাসী হোমে। তার আত্মজীবনী নিয়ে ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় একটি বই ‘টার্মিনাল ম্যান’। ‘লস্ট ইন ট্রানজিট’ নামের একটি ফরাসি সিনেমাও গড়ে ওঠে তাঁকে নিয়ে।

Advt

Previous article“গণধর্ষিতা কেন রাতে একা বেরিয়েছিলেন”, প্রশ্ন তুললেন মহিলা কমিশনের সদস্য
Next articleনন্দীগ্রামে আজ প্রথমবার ‘শক্তি’ দেখাবে বিজেপি, থাকবেন গেরুয়া শিবিরের শীর্ষ নেতারা