‘হোম-ম্যাচ’ ইনিংসে হেরে ‘অ্যাওয়ে ম্যাচ’ জিততে চায় বিজেপি: কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

দিল্লি দেশের রাজধানী৷

মোদিজি-শাহজি-সহ গোটা বিজেপির ডাকসাইটে নেতা-নেত্রীরা মূলত দিল্লিতেই থাকেন৷ সেই ২০১৪ থেকে দিল্লিতে ঘাঁটি গেড়েছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে জিতে আসা বিজেপি’র রথী-মহারথী নেতারা৷ মোদিজি, শাহজি তো আছেনই৷ ভোটপ্রচারে দিল্লি যেতে হলে প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা বিজেপি সভাপতির আলাদা ট্যুর-প্রোগ্রাম করতে হয় না, লাগে না হেলিপ্যাড৷ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতেই এধার থেকে ওধার করা যায়৷ এমনই চলছে সেই ২০১৪ থেকে৷

হঠাৎ এসব কথা বলার কারণ?

কারণ, এত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সেই ২০১৪- থেকে আজ পর্যন্ত দিল্লির মসনদে বসতেই পারছে না ‘দুনিয়ার বৃহত্তম দল’ বিজেপি৷ দিল্লিতে গেরুয়া ‘পোস্টার-বয়’-দের সশরীর-উপস্থিতি কাজে আসছেনা, ‘জয় শ্রীরাম’ কাজ করছে না, ‘সেন্ট্রাল ফোর্স’ কাজে লাগছে না, রথ, পুষ্পক-রথও ব্যর্থ ৷ এমনকী শ্রীরামচন্দ্র-ও হালে পানি পাচ্ছেন না৷
নরেন্দ্র মোদিজি দেশের প্রধানমন্ত্রী সেই ২০১৪ থেকে৷ এর মাঝেই ২০১৫ এবং ২০২০ সালে দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে৷ দেশের শাসক দলের হেরে যাওয়ারও একটা লেভেল আছে৷ বিজেপি প্রথমবার পেয়েছে ৩টি, পরের বার ৮টি আসন৷ নির্বাচনী ইতিহাস বলছে, দিল্লিতে মোদি-শাহের জাদু বা কালোজাদু অথবা যাদু-টোনা দাঁত ফোটাতেই বার বার ব্যর্থ হচ্ছে৷ দিল্লিতে বিজেপি-রাজ ছিল ২২-২৩ বছর আগে৷ প্রয়াত সুষমা স্বরাজই দিল্লিতে বিজেপির আপাতত শেষ মুখ্যমন্ত্রী৷ দিল্লিতে বিজেপি-রাজ খতম হয় ১৯৯৮ সালের ৩ ডিসেম্বর৷ তারপর থেকে বিজেপি কিছুতেই আর দিল্লির ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে পারছে না৷ এবং শেষ দুই নির্বাচনে তো মোদি-শাহ পর্যুদস্ত হয়েছেন দিল্লির আঞ্চলিক দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ সংবিধান অনুসারে দিল্লি একটি অর্ধ-রাজ্য৷ দিল্লির সরকার আসলে ‘সামান্য বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন’ একটি পুরসভা মাত্র৷ দিল্লির প্রাণভোমরা সাংবিধানিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে৷ তবুও বার বার ইনিংসে হারছে মোদি-শাহের দল৷

‘ঘরের মাঠে’ সব ধরনের ‘অ্যাডভানটেজ’ নিয়েও যে দল সর্বোচ্চ ৮ আসনে থেমে যায়, সেখানে বাংলায় বিজেপি’র এই উচ্চাশার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ এটা বলতেই ‘শিবের গীত’ গাইতে হলো৷

কেউই ভোলেননি ২০২০-এর দিল্লি ভোটে জিততে কী কী করেছিলো বিজেপি৷ মোদিজি ক্ষমতায় আসার ঠিক পরের বছর, ২০১৫ সালে, দিল্লি বিধানসভার ভোট হয়েছিলো৷ তখনও বিজেপি’র গায়ে নতুন বৌ-এর গন্ধ৷ সেবার ৭০ আসনের দিল্লি বিধানসভায় বিজেপি পায় মাত্র ৩টি আসন৷ বাকি ৬৭ আসনই চলে যায় আম আদমি পার্টির দখলে৷ ২০১৫-র নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরেন কেজরিওয়াল৷ দিল্লির শাসন ক্ষমতা দখলের ম্যাজিক-ফিগার মাত্র ৩৬, কারন দিল্লি বিধানসভা ৭০ সদস্যের৷ পরের পর রাজ্য হাতছাড়া হওয়ার পর নিজেদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে দিল্লির ২০২০-এর নির্বাচন বিজেপির শীর্ষ নেতাদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ন ছিলো৷ তাই ২০২০ সালে ম্যাজিক-ফিগার ৩৬ আসন ছুঁতে মহা-বিশ্বযুদ্ধ ঘোষনা করেছিলো বিজেপি৷ দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রায় সব ক’জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, শ’তিনেক সাংসদ, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী নেই, সে রাজ্যের বিরোধী নেতারা, হয়তো শীর্ষস্তরের প্রশাসনিক কর্তারা, হয়তো দেশের সব ক’টি কেন্দ্রীয় এজেন্সি, প্রায় সব সংবাদমাধ্যম এবং সবার উপরে অমিতবিক্রমশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ ৩৬টি আসন সংগ্রহ করতে এটাই ছিলো ২০২০-এর বিজেপি- ব্রিগেড৷ বিপক্ষে কোনও জাতীয় দল ছিলো না৷ মাত্র ২০১২ সালে আত্মপ্রকাশ করা নবীন একটি দল, ‘আম আদমি পার্টি’র সঙ্গেই ছিলো গেরুয়া-লড়াই৷ ২০১৫-র মতো ২০২০ সালেও সেই দলটিকে হারাতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন দেশের শীর্ষ-শাসকরা৷

দিল্লি ভোটে অসম্ভব সক্রিয় ছিলেন অমিত শাহ স্বয়ং৷ পথসভা-মিছিল- মিটিং ছাড়াও ওনাকে ২০২০-এ দেখা গিয়েছে বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে নিজের হাতে লিফলেট পর্যন্ত বিলি করতে৷ কিন্তু ২০২০ সালেও দিল্লিবাসী মোদি-শাহকে পর্যুদস্ত করে আপ-এর হাতেই নিজেদের ভবিষ্যত সঁপে দিয়েছেন৷ গেরুয়া নেতারা আজ যতই অস্বীকার করুন, দিল্লি হাতছাড়া হওয়ার ফলে গোটা দেশেই বিজেপির ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়৷
মোদিজির বিকাশের রথ যাত্রা শুরু করেছিলো ২০১৪ সালে৷ তারপরেও ২০১৫-র নির্বাচনে ৭০ আসনের মধ্যে ৩টি পেয়েছিলো বিজেপি৷ ২০২০-তে ওই শক্তিশালী, ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী বিজেপি- ব্রিগেডের অসামান্য কৃতিত্বে বিজেপির ৫টি আসন বাড়িয়ে দাঁড়ায় ৮ আসনে৷ মহাযুদ্ধে নেমে মোদি-শাহ আম আদমির হাত থেকে পাঁচ-পাঁচটি আসন কেড়ে নিয়ে চরম সাফল্য প্রদর্শন করে ২০২০-এ৷ সন্দেহ নেই, দেশের শাসক দলের আসমুদ্রহিমাচলের নেতারা ঝাঁপিয়েছিলেন বলেই দিল্লিতে বিজেপি বাড়াতে পেরেছে ৫টি আসন৷ এই তথ্য মাথায় রাখার পরেও নিশ্চয়ই বিজেপি’র নেতা-কর্মী- সমর্থকরা দাবি করবেন, দেশের জনপ্রিয়তম, বিশ্বাসযোগ্য (তম), গ্রহনযোগ্য (তম), কর্মদক্ষ (তম) দুই বিকাশ-পুরুষের নাম নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ৷
অমিত শাহকে ‘চাণক্য’ বলতে পছন্দ করেন ভক্তরা৷ এই ‘চাণক্য’ সাহেবের সুপরামর্শে, সুনেতৃত্বে এবং সুপরিচালনার নিট ফল, বিজেপির দিল্লির ‘পরিবর্তন-রথ’ থেমে যায় ৮ আসনে এসেই৷

তাহলে বাংলা-দখল নিয়ে বিজেপি এত মজে আছে কেন ? দিল্লি- বাংলায় ফারাক কতখানি? দিল্লি- দখল করতে কী কী করেনি বিজেপি? বাংলায় সেই কাজ শুরুও করেছে৷ ভোট যত এগোবে, দিল্লি- কলকাতা উড়ান ভর্তি করে বাংলায় নামবে ‘অজেয়’ নারায়ণী- সেনা’রা৷ দিল্লিতে ধাক্কা খাওয়া সেই একই সম্রাট, একই সেনাপতি, একই প্রচারের ঢং, একই সেন্ট্রাল-এজেন্সি নিয়ে বাংলা দখল অভিযান শুরুও হয়েছে৷ দিল্লিতে গেরুয়া আস্ফালনের ঘাটতি এতটুকুও ছিলো না৷ এখানেও নেই৷ তবুও ওখানে ক্লিক করেনি৷ সব বিষয়ে হুঙ্কার আর হুমকি ব্যুমেরাং হয়ে গেরুয়া শিবিরকেই রক্তাক্ত করছে৷ দিল্লির সদ্য-রাজনীতিতে আসা কেজরিওয়ালকে হারাতে যারা মুখ থুবড়ে পড়েছেন বার বার, তাঁরাই নাকি বাংলায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হেলায় হারিয়ে দেবেন !

আরও পড়ুন:জিটি রোড অবরোধ করে পুলিশের সামনেই ফুটবল খেলল অবরোধকারীরা

দিল্লির ভোটে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছেন, দেশের স্বঘোষিত চাণক্য-রা ‘ঝাড়ু’-ঝড়ে কীভাবে ‘পাপ্পু’-তে রূপান্তরিত হয়েছিলেন৷ ‘হোম-ম্যাচে’ বার বার ইনিংসে হারার রেকর্ড নিয়ে ‘অ্যাওয়ে ম্যাচে’ চমক দেখানোর ইচ্ছা থাকা ভালো৷ চেষ্টা না থাকলে ‘বড়’ হওয়া যায়না!

Advt

Previous articleএক ধাক্কায় অনেকটাই বাড়ানো হল বিমান ভাড়া
Next articleবনধ উপেক্ষা করায় বেধড়ক মার বাইক আরোহীকে, আক্রান্ত ট্যাক্সি-অটো চালকরাও