
ফ্যাসিজিম যাদের আদর্শ তাদের কছে চূড়ান্ত একনায়কতন্ত্র ছাড়া আর কিই বা আশা করা। একসময় আর এসএস এর নেতা বি এস মুন্জে ইতালী গিয়ে নাৎসিদের কাজকর্মে দেখে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গিয়েছিলেন।১৯৩১ সালের ১৯ মার্চ মুসোলিনির সাথে আলোচনা ও বালিল্লা ও ফ্যাসিস্ত সংগঠনগুলি দেখে যে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন তা তার ডায়েরিতে লেখা আছে।পরবর্তীকালে ১৯৪০ সালে সাভারকরও হিটলারের নাৎসিবাদ ও মুসোলিনির ফ্যাসিবাদকে খুবই পছন্দ করতেন যা ১৯৪০ সালে মাদুরায় হিন্দু মহাসভার ২২ তম অধিবেশনে সভাপতির ভাষনে পরিষ্কার। তারও পরে তিনি নেহেরুকে নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরোধীতা করার জন্য আক্রমন করেছিলেন। তাই এই সব লোকেরা দেশের স্বাধীনতার জন্য কোন ত্যাগ স্বীকার না করে, বরং ব্রিটিশদের পদলেহন করে হিটলারের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে আরএসএস সংগঠনকে সেই ধাঁচে গড়েছিলেন।পরবর্তীকালে গোলওয়ালকর বা হেডগেওয়ারও একই পথের পথিক ছিলেন। যা আজও আরএসএস এর মধ্যে বিদ্যমান। বস্তুতঃ ফ্যাসিস্ত শক্তির ধারাবাহিকতা বহন করে চলেছে আরএসএস ও তাদের রাজনৈতিক দল বিজেপি। নাৎসীদের ডিএনএ যে আজ বিজেপি দলের ও তাদের পরিচালিত সরকারের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে তা তাদের কয়েক বছরের বিভিন্ন কাজে দারুনভাবে প্রতিফলিত। সরকার বিরোধী কথা বললেই রাষ্ট্রদোহ মামলা লাগু করে অনির্দিষ্টকাল ধরে বিনা বিচারে জেলে পুরে রাখা।অতি বৃদ্ধ বা কৈশোর পার করা মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী অথবা সমাজকর্মী কিংবা কোন খবর করতে যাওয়া সংবাদিক এমনকি শিশুদের প্রান বাঁচানোর চেষ্টার দায়ে ডাক্টারকে ঐ একই মামলায় দোষী সব্যস্ত করার কোন চেষ্টাই বাদ যায় নি।একই সাথে নাৎসীদের প্রচারসচিব গোয়েবেলসীয় পথে অবিরত মিথ্যা প্রচার। যিনি বিশ্বাস করতেন একটা মিথ্যাকে বড় আকারে এমনভাবে বার বার প্রচার করতে হবে যাতে মানুষ শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে সেই মিথ্যাকেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। সেই তত্ত্বের ধারক ও বাহক এখন বিজেপির আই টি সেল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তাদের প্রচার বিভাগের এমন ক্ষমতা আছে যে মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে কোন মিথ্যা সংবাদ পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।

তবে একটা কথা আছে না কেউ কিছু মানুষকে অল্প কিছুদিনের জন্য বোকা বানাতে পারে,কিছু মানুষকে কখনওই বোকা বানানো যায় না আর আর অল্প কিছু মানুষ সর্বদাই বোকা বনে।তাই আজ প্রযুক্তির কল্যানে মিথ্যা সংবাদ ধরা পড়া খুব বেশী শক্ত নয়। যদিও খুব বেশী মানুষ উক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে আগ্রহ দেখান না।
এইভাবেই কয়েকবছর ধরে বিজেপি দেশের সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষকে মিথ্যা প্রচারে বোকা বানানোর পর এতদিনে দেশের মানুষ বোধহয় আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন তাদের স্বরূপ। তাই দেশ জুড়ে সর্বস্তরের মানুষ আজ কারাগারের ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে ভয় পাচ্ছেন না। বিজেপি হয়ত আন্দাজ করতে পারছে যে এইভাবে চিরকাল চলবে না। করোনা পরিস্থিতি তাদের সরকার চালানোর অদক্ষতাকে বেআব্রু করে দিয়েছে। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা,রাষ্ট্রপুঞ্জ,বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সবাই ভারতের বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিবেশের তীব্র সমালেচনা করেছে। তারা করোনা মোকাবিলায় মোদি সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছে। তাতেও মোদি সরকার বা বিজেপির কোন হেলদোল প্রকাশ্যে দেখাচ্ছে না। এবার তারা জালিয়াতিরও আশ্রয় নিয়েছে। কংগ্রেসের তৈরি টুলকিট কান্ডে তা প্রমানিত।

কয়েকদিন আগে কংগ্রেসের গবেষণা বিভাগ তার কর্মীদের জন্য একটি টুলকিট তৈরি করেছিল। মূলতঃ কোভিড ও সেন্ত্রাল ভিস্তা সংক্রান্ত কিছু তথ্য নিয়ে দুটি অংশে আট পাতার এই টুলকিটটি। প্রথমাংশে কোভিড ও দ্বিতীয়াংশে সেন্ত্রাল ভিস্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সেখানে ছিল। বিজেপি কংগ্রেসের রিসার্চ বিভাগের লেটারহেড জালিয়াতি করে সেই টুলকিটের চার পৃষ্ঠা পরিবর্তন করে ভুয়ো টুলকিট তৈরি করে তা কংগ্রেসের টুলকিট বলে প্রচার করে। দলের মুখপাত্র সম্বিত পাত্র,মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী, দলের সহসভাপতি রমন সিং,বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি( সংগঠন) বি এল সন্তোষ প্রমূখদের দিয়ে টুইট করানো হয়। পরে তা অনেক মন্ত্রী শেয়ার করেন। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে সম্বিত পাত্র সাংবাদিক সম্মেলনে মন্তব্য করেন যে কংগ্রেস মোদির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তারা প্রচার করে, সাম্প্রতিক যে নতুন স্ট্রেন দেশে বিপর্যয় এনেছে তাকে মোদি স্ট্রেন হিসাবে প্রচার করতে ঐ টুলকিটটিতে বলা হয়েছে। যা সর্বৈব মিথ্যে।

এই মিথ্যা ও জালিয়াতি করা টুলকিট নিয়ে টুইটার কর্তৃপক্ষকে জানায় কংগ্রেসের সোস্যাল মিডিয়ার প্রধান রোহন গুপ্ত ও গবেষনা বিভাগের প্রধান রাজীব গৌড়া। টুইটার কতৃপক্ষ তদন্ত করে সম্বিত পাত্রদের করা জালিয়াতি করা টুইটটিকে ‘কারসাজি করা মিডিয়া’ বা “ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া “এর তকমা দিয়ে তা মুছে ফেলেছে। একই সাথে তাদের টুইটার অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করে দিয়েছে। কারণ টুইটারের নীতি অনুযায়ী কারসাজি করা মিডিয়া যা থেকে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা টু্ইট করা যাবে না।একেবারেই সঠিক সিদ্ধান্ত ।তারপরেই কেন্দ্রীয় বৈদুতিন ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক টুইটারকে কড়া চিঠি দেয়।কিন্তু কেন একটা সরকারী দপ্তর বিজেপি নেতাদের হয়ে গলা ফাটাবে? বিজেপি দল থেকে যদি একথা বলা হত তাহলে বলার কিছু থাকতো না।সরকার ও দলের মধ্যে নূন্যতম তফাৎ বিজেপি রাখে নি। এ কোন দেশে আমরা বাস করছি?


এ ঘটনার দুদিন পড়েই টুইটার কে ভয় দেখানো শুরু হল। দিল্লী ও গুরুগ্রামে টুইটার ইন্ডিয়ার অফিসে হাজির হল দিল্লী পুলিশ। কেন গেল তারা আর কার অভিযোগের ভিত্তিতে তা আজও জানা যায় নি। একটা নোটিশ দিয়েছে তারা, শুধু এটুকুই জানা গেছে।

আরও পড়ুন- তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে চড়া সুর কংগ্রেসের

এদিকে ছত্রিশগড়ে কংগ্রেসের তরফে রমন সিং ও সম্বিৎ পাত্রের বিরুদ্ধে এফ আই আর দায়ের করা হয়। সাথে সাথে অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধিনস্থ দিল্লি পুলিশ ছত্রিসগড় কংগ্রেসের দুই নেতা যারা এফআইআর করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে নোটিশ পাঠাল। এযেন শিব ঠাকুরের আপন দেশে,আইন কানুন সর্বনেশের মত অবস্থা। দোষীরাই নির্দোষদের বিচার করবে,তাদের কাজকর্ম নিয়ে তদন্ত করছে।রাহুল গান্ধি যথার্থই বলেছেন “সত্য কখনও ভয় পায় না”। মহাত্মাজিও তাই বিশ্বাস করতেন। আসলে সমাজের মধ্যে বিভেদ ছড়াতে ও কংগ্রেসকে হেয় করতেই যে বিজেপি এই কুকীর্তি করেছে তা বলাই বাহুল্য। কংগ্রেস ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ও আই টি আইনে মামলা করার কথা ঘোষনা করেছে ও দাবী করেছে যে ডিভাইস থেকে এই জালিয়াতি করা হয়েছে তা অবিলম্বে ক্রোক করা হোক।

গত কয়েকমাস ধরে কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড মোকাবিলায় যে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ও দেশবাসীর প্রতি অমানবিক আচরন করেছে তা আজ বিশ্ব জুড়ে সমালোচিত।ফলে মোদি সরকারের এখম ব্যাঙের ছুঁচো গেলার মত হাল। পিএম কেয়ার্সের বিশাল অঙ্কের টাকার কোন হিসাব নেই। জনগনের করের টাকা দেশের মানুষের দূরাবস্থার সময় তাদের কল্যানে খরচ না করে মোদীর ভ্যনিটি বা গর্বের সেন্ত্রাল ভিস্তার মত অপ্রয়োজনীয় একটা ফালতু কাজে ব্যবহার করা ও সেই প্রকল্পকে জরুরি কাজের তকমা দিয়ে রাতদিন সেই নির্মাণকাজ চালিয়ে যাওয়ায় দেশের মানুষ শুধু নয় বিশ্বব্যাপী ধিক্কারের পাত্র হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। মোদির ভাবমূর্তি তলানিতে। একজন অতি সাধারন অযোগ্য মানুষকে বিরাট নেতা বানাতে গিয়ে বিজেপি এখন মহা ফ্যাসাদে পড়েছে। তাই এতসব অকর্মণ্যতা ঢাকা দিতে ও একইসাথে মোদির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য তাদের জালিয়াতি পর্যন্ত করতে বাধছে না। যে বা যারা কোন প্রশ্ন করছে তাদের জন্য তো রয়েছে ইউএপিএ আইন। তাই ছাত্র, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, লেখকসহ সমস্ত রকমের বিদ্বজন বা সিভিল সোসাইটির মানুষেরা সরকারের লক্ষ্য। তাদের মুখ কিভাবে বন্ধ করা যায় সেই চিন্তাই ঘুরছে তাদের মনে। তাই ছয় মাস ধরে সিংঘু সীমানায় আন্দোলনরত কৃষকদের খালিস্থানী, মাওবাদী বা চীন বা পাকিস্তানের এজেন্ট বলে দাগিয়ে দিতে তাদের বিবেকে লাগে নি। দেশ যখন এক অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়ছে,যখন দেশ জুড়ে আক্রান্তরা হাসপাতালের একটি বেডের জন্য হাহাকার করছেন, অক্সিজেনের অভাবে দেশের অনেক হাসপাতাল যখন রোগী ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, দেশজুড়ে ওষুধের আকাল,টিকার অভাবে মানুষ হাপিত্যেস করছে,রাস্তায় বা পার্কিং লটে সারি সারি মৃতদের দাহ করার ছবি সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে গঙ্গা যমুনায় সার দিয়ে মৃতদেহ ভাসছে, শব খুবলে খাচ্ছে শেয়াল কুকুর চিল শকুনেরা, পোষ্যদের কবর দওয়ার জায়গায় শবদাহ চলছে। দেশজুড়ে মৃত্যুমিছিল। অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও এটাই ভারতের বর্তমান অবস্থা। সংক্রমণ দমনের কোন জাতীয় পরিকল্পনা নেই। দীর্ঘদিনের তৈরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। রাজ্যদের ও জনগনের হাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। অবিরত মৃত্যু ও সংক্রমণের তথ্য ও সংখ্যা চেপে যাচ্ছে সরকার। এই ব্যাপারে কোন সঠিক তথ্য কেউ প্রকাশ করলে তাকে জেলে পোরার হুমকি দিচ্ছে কোন কোন বিজেপি শাসিত সরকার।কুম্ভমেলার অনুমতি দিয়ে বা মোদি-শাহরা নির্বাচনের প্রচারের নামে দেশজুড়ে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। সব ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েই এখন বিজেপি দেশের মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে কখনো বিরোধী রাজ্য সরকারকে প্যাঁচে ফেলছে বা কংগ্রেসের নামে বদনাম করতে জালিয়াতির আশ্রয় অব্দি নিতে হচ্ছে। একইসাথে আন্তর্জাতিক সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোকে ভয় দেখিয়ে বা চাপ সৃষ্টি করে তাদের তাবেদারি করতে বাধ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজেরা যত খুশী মিথ্যা, ভুয়ো ও জালিয়াতি করা জিনিস প্রচার করবে অন্যদিকে কাউকে সত্যপ্রচারে বাধা দেওয়ার চেষ্টা। এটাই তাদের পুরানো রণকৌশল। রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতা প্রয়োগ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলন কর তাদের মূল উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন- সোমবারই অবসর নিয়ে রাজ্যের বিশেষ পদে আলাপন? জল্পনা তুঙ্গে

