অবতার-পুরুষ সেদিন ফিরেছিলেন অভুক্ত, জয়ন্ত ঘোষের কলম

[ আজ, ৯ আষাঢ়, ১৪২৮, বৃহস্পতিবার৷ জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা৷ পঞ্জিকা অনুসারে আজ স্নানযাত্রা৷

এই দিনটিকে জগন্নাথদেবের জন্মতিথি মনে করা হয়। এইদিন পুরীতে স্নানযাত্রা উপলক্ষ্যে জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা, সুদর্শন চক্র ও মদনমোহন বিগ্রহকে জগন্নাথ মন্দির থেকে স্নানবেদিতে আনা হয়। সেখানে তাদের প্রথাগতভাবে স্নান করানো হয়৷

পাশাপাশি এই স্নানযাত্রার দিনটি আরও একটি দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৷
১৮৫৫ সালের ৩১ মে’ও ছিলো এমনই এক স্নানযাত্রার দিন৷ ওইদিনেই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মহাসমারোহে মাতা ভবতারিণী কালিকামূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো৷ সেই বিষয়েই এই বিশেষ প্রতিবেদন৷ ]

বাংলার ইতিহাস বড় বিচিত্র৷ সৃষ্টি হয়, কিন্তু সূচনার ইতিহাসে স্রষ্টাই উপেক্ষিত থেকে যান।
সূচনার পুণ্যলগ্নে স্রষ্টাই না খেয়ে চলে গেলেন!

ঝামাপুকুরের রাজা দিগম্বর মিত্রের বাড়ির নিত্য পূজারি চতুষ্পাঠী টোলের পণ্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে ও শাস্ত্রীয় তত্ত্বাবধানে সকল বাদবিতন্ডার অবসান ঘটিয়ে শুভসূচনা হতে চলেছে দক্ষিণেশ্বরের ঐতিহাসিক মা ভবতারিণীর মন্দির।

সে অনেক কান্ড! রানি রাসমনি যাচ্ছিলেন কাশীর মা অন্নপূর্ণাকে পূজা দিতে, আর পথে কাশীপুরে মা চিত্তেশ্বরীর স্বপ্নাদেশে বদলে গেল মনোরথ। স্বয়ং মা ভবতারিণীর অভিলাষ, তিনি রাসমনির নিত্যসেবা গ্রহন করবেন। অতএব রানি ঠেকে গেলেন সম্বলপুর বা শোনিতপুরে। যার বর্তমান নাম দক্ষিণবঙ্গের বানলিঙ্গ শিবের নামে দক্ষিণেশ্বর। রানির ইচ্ছা ছিল গঙ্গার বারাণসী সমতুল পশ্চিমপাড়েই মনোরম মন্দির গড়ে উঠুক। কিন্তু বিধির ইচ্ছা ছিল অন্যকিছু! অনেক চেষ্টা করেও শূদ্রানি রানি পশ্চিমতটে কোনওমতেই একটু জায়গা পেলেন না। বর্ণবিদ্বেষী ব্রাহ্মণ আর অহংকারি ধনাঢ্য জমিদারদের চক্রান্তে জাতে কৈবর্ত্যের রানির কেনা হল না দেবালয়ের জমি। অগত্যা পূর্বপাড়েই স্থির হল মন্দির হবে।

শেষপর্যন্ত বরাতজোরে ম্লেচ্ছ জন হেস্টি’র বাগান বাড়িটিই পছন্দ হল। কুর্মাকৃতি ভূমি, শ্মশান, দরগা, পুকুর ও ভাগীরথীর তটে শাস্ত্রমতে উত্তম দেবালয় ও সাধনক্ষেত্র হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর ১৮৪৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪২ হাজার ৫০০ টাকায় বিল অফ সেল-এর মাধ্যমে মোট সাড়ে ৫৪ বিঘা জমি কেনা হল। তখনকার দিনে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ম্যাকিনটোশ বার্ন লিমিটেড কোম্পানিকে দিয়ে ৭,৮৪,৮০০ বর্গফুট জমিতে ৪৪০ ফুট লম্বা ও ২২০ ফুট চওড়া মন্দির তৈরি হলো৷ সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৯ লক্ষ টাকা খরচ করে সৃষ্টি হল রানি রাসমনির সাধের দেবালয়। উৎসর্গীকৃত মন্দিরের ফলকে খোদাই থাকলো, কালীপদ অভিলাষী দাসী রাসমনি।

এবার মন্দিরের কাজ শুরু হতেই তোড়জোড় শুরু হল মূর্তি তৈরি করার। বর্ধমানের কাটোয়া সংলগ্ন দাঁইহাটের বিখ্যাত শিল্পী নবীন ভান্ডারী। রাজার উপাধিতে নবীন ভাস্কর। ছেনি-হাতুড়ির শৈল্পিক সংঘর্ষে অষ্টধাতু ও কষ্টিপাথরে সৃষ্টি হল মা কালীর মূর্তি, মা ভবতারিণী৷ রানি রাসমনির দেবালয়ে প্রতিষ্ঠিতা দেবী৷ শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দময়ী মা।

দেবী ভবতারিণীর মাতৃমূর্তি তো তৈরি হল কিন্তু মন্দির তৈরি করতেই লেগে গেল প্রায় ৭ বছর। এদিকে বাক্স বন্দি মা ভবতারিণীও ঘেমে নেয়ে উঠলেন! রানি পড়লেন ফাঁপড়ে। ওদিকে সমাজে নাগাড়ে চলতে থাকল বিরোধিতা ও শত্রুতার চোরাগোপ্তা আক্রমণ। কৈবর্ত্যের মন্দিরে কোনও ব্রাহ্মণ পুজো করবেনা, এমন ফরমান জারি হল। সবাই বেঁকে বসলেও ঝামাপুকুরের চতুষ্পাঠী টোলের পন্ডিত উদারপন্থী রামকুমার চট্টোপাধ্যায় শেষপর্যন্ত রাজি হলেন। তবে উপায় সেই পাগলা বামুন গদাই-ই বার করে দিলেন। বললেন, “কোনও ব্রাহ্মণকে যদি গোটা মন্দিরটি উৎসর্গ করে দেওয়া যায় তবে আর বিরোধ কিসের?” এমন চমকপ্রদ সমাধান পরবর্তীকালে আরও দেখাবেন তিনি! রামকুমার রানির জামাই মথুরবাবুকে এই সমাধানের কথা জানাতেই মথুরবাবু তাঁকেই চেপে ধরলেন মন্দিরের পূজার যাবতীয় ভার গ্রহন করার জন্য। রামকুমারও সংসারের অনটনের কথা ভেবে অবশেষে নিমরাজি হলেন। কিন্তু ছোট ভাই গদাধর মনে মনে রুষ্ট হলেন। কারণ রামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অশূদ্রযাজি, অপরিগ্রাহী সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। তাঁর সন্তান হয়ে কিনা বড়ভাই রামকুমার কৈবর্ত্যের মন্দিরের ভার নিলেন?

খুবই খাপ্পা হলেন খেয়ালি মনের অবতারপুরুষ! দাদা যাই করুন, তিনি কিন্তু তাঁর পিতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দেবেন না, এই বলেই গোঁ ধরে থাকলেন। তিনি নিজেই উপায় বাতলালেও সংস্কারের বশে শূদ্রের অন্নজল গ্রহনে অপারগ।

নির্দিষ্ট দিনে, অর্থাৎ ১৮৫৫ সালের ৩১ মে শ্রীজগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার শুভদিনে মহাসমারোহে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠা হল। প্রচুর মানুষের সমাগম। লোকে লোকারণ্য। দান-ধ্যান, হোম-যজ্ঞ, সানাই-বাদ্যি ইত্যাদিতে জাঁকজমকে গোটা মন্দির চত্বর একেবারে গমগম করতে লাগল।
এরই মাঝে ঘটে গেল সেই অনভিপ্রেত ঘটনা। যিনি ভবিষ্যতে এই মন্দিরের প্রাণপুরুষ হয়ে উঠবেন সেই তিনি কিন্তু অনাহুত অতিথি হয়ে সারা মন্দির ঘুরে ঘুরে দাদাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে নিরাশ হয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খেতে খেতে হাঁটতে হাঁটতে ঝামাপুকুরে ফিরে এসেছিলেন। কত শত বামুনের দল সিধের (প্রণামী) লোভে সেখানে লম্বা লাইন দিয়ে রানির দান গ্রহন করলেন, আর যিনি সেই মন্দিরকেই ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক করে তুলবেন, তিনি চালকলা বাধা বিদ্যায় আগ্রহী হলেন না!

আসলে সেই শুভদিনেই ঠাকুর তাঁর নাড়াখানি বেঁধে নিয়েছিলেন মা ভবতারিণীর সাথে। জগতের নাথের জন্মদিনে জগজ্জননীর মন্দির প্রতিষ্ঠা ও আশ্চর্য তার পুরোহিত এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। সেইজন্যেই আজও স্নানযাত্রার দিনে বেলুড় মঠে ‘আত্মারামের কৌটো’খানি (শ্রীরামকৃষ্ণের পূতাস্থি ভরা কলস) ষোড়শোপচারে জগন্নাথজ্ঞানে পূজা করা হয়।

Previous articleব্রেকফাস্ট স্পোর্টস
Next articleপেট্রোলের দামে ছ্যাঁকা! লক্ষীবারেও দাম বাড়ল জ্বালানির