শাড়ি নয়, মালদহের সেনবাড়ির কলাবউ ঘাঘরা পরে নদীতে যান

সন্ধে নেমে এসেছে৷ মহানন্দার ঘাট তখন শুনসান৷ আশেপাশের জঙ্গলে থাকা শিয়ালের দল রাত জাগার প্রস্তুতি ৷ ঠিক সেই সময়, গোধূলি বেলায় শালগ্রাম শিলা হাতে পুরোহিত ছুটছেন নদীর ঘাটে৷ রীতি মেনে জমিদারবাড়ির শালগ্রাম শিলাকে এই লগ্নেই নদীতে স্নান করাতে হবে৷ তারপর সেই শালগ্রাম নিয়ে তিনি চলে যাবেন নিজের বাড়িতে৷ অনেক পুরোনো রীতি৷ সেনবাড়ির শালগ্রাম শিলা তাঁর বাড়িতেই রাত কাটায়৷ পরদিন ভোরে নারায়ণ ফের ফিরে যান জমিদারবাড়িতে৷ অব্রাহ্মণ জমিদার নিজেই শালগ্রাম শিলার জন্য বেঁধে দিয়েছিলেন এই রীতি৷

দূর থেকে নদীর ঘাটে নৌকা বাঁধা দেখে খানিকটা আশ্চর্য হয়েছিলেন পুরোহিত৷ ঘাটে পৌঁছে তিনি দেখেন, ওই নৌকা থেকে নেমে আসছেন এক সুন্দরী রমণী৷ সঙ্গে দুই ছেলে, দুই মেয়ে৷ ওই রমণী পুরোহিতের কাছে জমিদারবাড়ির রাস্তা জানতে চান৷ কিন্তু হাতে শালগ্রাম নিয়ে কথা বলা নিষেধ৷ তাই পুরোহিত ইঙ্গিতে ওই মহিলাকে জমিদারবাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দেন৷ এরপর শালগ্রামকে স্নান করিয়ে বাড়ি চলে যান তিনি৷ তবে তাঁর মনে সন্দেহ জাগে, ভরসন্ধেয় একা ছেলেমেয়ে নিয়ে নৌকায় ওই সুন্দরী রমণী কেন জমিদার বাড়িতে যেতে চান?

পুরোহিতকে পরদিন এনিয়ে জমিদারবাড়িতে কাউকে প্রশ্ন করতে হয়নি৷ ততক্ষণে সবাই জেনে ফেলেছে, ওই রাতে দেবীর স্বপ্নাদেশ পান জমিদার রমেশচন্দ্র সেন৷ স্বপ্নে দেবী তাঁকে আদেশ দেন, ছেলেমেয়ে নিয়ে তারা পৌঁছে গিয়েছেন৷ জমিদার যেন মন্দির নির্মাণ করে তাঁকে স্থাপন করেন৷ পুজোর কিছু সামগ্রী তিনি নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন৷ সেসব নদীর ঘাটে রয়েছে৷ ওই সামগ্রীগুলি যেন ঘাট থেকে তুলে আনা হয়৷ স্বপ্নে দেবীর নির্দেশ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে ভোর হতেই রমেশ চন্দ্র সেন লোকজন নিয়ে ছুটে যান নদীর ঘাটে৷ দেখেন, সত্যিই সেখানে পুজোর বেশ কিছু সামগ্রী ও খড়্গ পড়ে রয়েছে৷ সেসব বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি৷ এরপরেই তিনি বাড়ির পাশে মন্দির নির্মাণ করে পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রস্তুত করান৷ শুরু হয় বর্তমানে জেলার অন্যতম প্রাচীন, বাচামারির সেনবাড়ির দুর্গাপুজো৷

 

পুজো প্রবর্তনের ঠিক এই কাহিনীটাই বলছিলেন বর্তমানে এই পুজোর সেবাইত, দাশগুপ্ত পরিবারের প্রবীণ সদস্য প্রলয়পতি দাশগুপ্ত৷ তিনি জানান, “এই পুজো শুধু পুরাতন মালদহ নয়, জেলার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন৷ পুজো ৫০০ বছরে পা দিল৷ গোটা জেলায় সেনবাড়ির পুজো নামে পরিচিত৷ তবে সেনদের কোনও বংশধর এখন আর বেঁচে নেই৷ অনেক আগেই সেই বংশ নিশ্চিহ্ন হয়েছে৷ হয়তো পরবর্তীতে সেই বংশের মেয়েদের কোনও সন্তানের হাতে এই পুজোর ভার যায়৷ সেখান থেকে আমাদের হাতে এসে পৌঁছোয়৷ এখন আমরা এই বংশের পাঁচ পরিবার মিলে পুজো পরিচালনা করে আসছি৷ দেবীর স্বপ্নাদেশে জমিদার মহেশচন্দ্র সেন প্রথমে ঘটে, তারপর পটে এবং শেষে মূর্তিপুজোর প্রচলন করেন৷ দেবীর স্বপ্নাদেশে তিনি মহানন্দার ঘাটে পুজোর যেসব উপকরণ পেয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল দুটি পুষ্পপত্র, একটি গাড়ু, একটি পানের বাটা, পাঁচটি খড়্গ সহ আরও কয়েকটি জিনিস৷ সেসব এখনও রয়েছে৷ শুরুর দিন থেকে প্রতি বছর পুজোয় এই জিনিসগুলি এখনও ব্যবহৃত হয়৷ দেবীর আদেশ অনুযায়ী এখনও ডাকের সাজে প্রতিমা তৈরি হয়”।

 

পরিবারের এক সদস্যা তনুশ্রী দাসগুপ্ত জানান “নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চমীর দিন প্রতিমা বেদীতে ওঠেন৷ ষষ্ঠীতে কল্পারম্ভ৷ সপ্তমীর সকালে কলা বউ নিয়ে মহানন্দায় যাওয়া হয়৷ প্রাচীন রীতি মেনে আমাদের কলা বউ শাড়ি নয়, ঘাঘরা পরে নদীতে যান ও আসেন৷ পুজোর বোধন শুরু হয় কৃষ্ণা নবমী তিথি থেকে ৷ পুজোয় বলিপ্রথা রয়েছে৷ আগে মহিষ বলির প্রথা ছিল । তা উঠে গিয়ে এখন পাঠাবলি হয়। সপ্তমীতে হয় সাদা পাঠাবলি। সন্ধিপুজোতে হয় কালো পাঠাবলি এবং মহানবমীতে হয় যে কোনো রঙের পাঠাবলি”।

 

advt 19

advt 19

 

 

 

 

Previous articleরাজধানী এক্সপ্রেস অপহরণ কাণ্ডে ছত্রধর-সহ আরও ১৩ জনকে চার্জশিট দিল NIA
Next articleভবানীপুরে প্রচারে সম্বিত পাত্রকে কটাক্ষ করে গান ‘তুম হো ঠ্যাহরে পরদেশি’, কী হল জানেন?