আজ যেতে হবে, ফিরব মমতার দলেই

সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও ছন্দবাণী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে লেখক কুণাল ঘোষ। লন্ডনের হ্যারোতে।
কুণাল ঘোষ

২০০৫।
রাত বারোটা।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের গড়িয়াহাটের বাড়ি।
ঘরে সুব্রতদা, আমি। আর মাঝেমধ্যে এসে দাঁড়াচ্ছেন ছন্দবাণী বউদি। রেগে লাল।
-‘হয় তোমরা খেয়েদেয়ে কথা বলো। না হয় বলে দাও খাবে না। তখন থেকে এক কথা চলছে।’
সমস্যা হল বিষয়টা এমনই যে খাওয়া তখন সুব্রতদার অগ্রাধিকার নয়। ফলে কথা চলছে তো চলছেই।
এবং সিদ্ধান্তহীনতা।
সময়টা গোলমেলে।
সামনে কলকাতা পুরভোট।
পাঁচ বছর তৃণমূল পুরবোর্ড চলার পর সুব্রতদা দল ছাড়তে চলেছেন। আগের দিন দুই পুরপিতা সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেছেন। কাজ হয়নি। অতঃপর এবার আমি সুব্রতদার কাছে।
যেহেতু স্নেহ করতেন, বহু বিষয়ে আবদার রাখতেন, ফলে একটা জোর ছিল।

ততক্ষণে মনস্থির করে নিয়েছেন সুব্রতদা। একটি মহল তাঁকে ভরপুর উসকেছে। কংগ্রেসের দুই শীর্ষনেতা প্রবল চাপ রেখেছেন। তৃণমূল ছেড়ে কোন প্রতীকে দাঁড়াবেন, কংগ্রেস কীভাবে সমর্থন করবে, সব পাকা। সংবাদমাধ্যমের একটি শিবির সমীক্ষা ছেপে চলেছে, তৃণমূল ছাড়লেও সুব্রতদাই মেয়র।
থম পাতার পর)
মেটানোর লোক কম। হাওয়া দেওয়ার লোক বেশি।
সুব্রতদার কিছু পদক্ষেপে মমতাদির খারাপ লেগেছিল। চটেছিলেন বিস্তর। কিন্তু তিনি কখনও চাননি সুব্রতদা দল ছেড়ে যান। অথচ দু’একজন মেয়র পারিষদ, পুরপিতাকে নিয়ে সুব্রতদা দল ছাড়তে তৈরি। মমতাদি মানসিকভাবে আহত।

আমি সুব্রতদার বাড়িতে বসে। মমতাদি জানতেন।
দীর্ঘ কথা হল। বোঝালাম, ‘আপনাদের দাদা-বোনের ব্যাপার। এর মধ্যে আমরা কে? সংসারে ঠোকাঠুকি হয়। কয়েকজন আপনাকে ভুল বুঝিয়ে নিজেদের স্বার্থে সবটা নষ্ট করছে। মানুষ বিরক্ত হচ্ছেন। দলের বাইরে গিয়ে আপনি মেয়র হতে পারবেন না।’
সুব্রতদা যে বুঝছিলেন না, তা নয়। নরমও হচ্ছিলেন। কিন্তু বিকল্পটা এতটাই কথা দেওয়া যে তিনি আবার অনড় হয়ে যাচ্ছিলেন।
আমি বলছিলাম, ‘দাদা, ফোনটা ধরি। একটিবার দিদির সঙ্গে কথা বলুন।’
সুব্রতদা একবার বলছেন, ‘বেশ ধরো।’ পরক্ষণেই বলছেন, ‘না থাক, আরেকটু ভাবি।’
চূড়ান্ত সিদ্ধান্তহীনতা।
যখন নরম হলেন, একবার বললেন,‘দাঁড়াও, ওদের একবার জানিয়ে দিই।’
ওদের মানে কাদের?
দুম করে জিজ্ঞেস করা যায় না। অনুমান, যাঁরা চান সুব্রতদা দল ছাড়ুন, সুব্রতদা যাঁদের কথা দিয়েছেন, তাঁদের।
সুব্রতদা ফোন করলেন।

শুরুটা ঠিকঠাক- ‘ওরা বলছে বারবার। ভাবছি দল ছেড়ে আর কী করব? কুণাল এসেছে ….’
তারপরেই ওদিক থেকে কিছু বলা চলছে।
সুব্রতদা শ্রোতা।
এবং শেষে চরম দ্বিধাগ্রস্তভাবে ফোন শেষ।
-‘বুঝলে কুণাল, খুব দেরি হয়ে গিয়েছে। আর হয় না।’
প্রশ্ন করিনি। বুঝেছি, ফোনের ওপাশে কে ছিলেন।
কয়েকদিন পরে তিনি আমাকে বেশ বকেছিলেন। কেন আমি সুব্রতদাকে ঠেকাতে গিয়েছিলাম।
যাই হোক, সেই রাতে আরও কিছুক্ষণ চলল।
বউদি দাদাকে বলছেন, ‘হয় মমতার সঙ্গে কথা বলো। না হয় একঘেয়ে আলোচনা বন্ধ করো। আর এসব চলতে পারে না।’
সুব্রতদা বললেন, ‘নাঃ। এযাত্রা আর পিছোতে পারব না। তবে এটা বলতে পারি, বাংলার রাজনীতিতে মমতা থাকবে। ওর একটা ভয়ানক কামব্যাক হবে। আমাকেও হয়তো আবার তৃণমূলেই ফিরতে হবে। যদি সেরকম হয়, আমি নিজে তোমাকেই বলব। কিন্তু আজ এখন আমার আর তৃণমূলে থাকার অবস্থা নেই। সবকিছু অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।’

রাত দেড়টায় সুব্রতদার বাড়ি থেকে বেরোলাম। মনটা ভারী। আফসোস, কেন ক’টা দিন আগেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রয়োগ করিনি। এখন তো কথা বলেই বুঝতে পারছি কে কে উসকেছে, কী কী বলে ভাঙন চওড়া করেছে। কিন্তু তখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে।
না। সুব্রতদা সেবার মেয়র হতে পারেননি। যাঁরা ভেবেছিলেন তৃণমূল ধ্বংস হবে, সেটাও হয়নি। বামফ্রন্ট বোর্ড গড়লেও তৃণমূল ভাল ফল করেছিল। অজিত পাঁজা, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েটদের পুরভোটে নামিয়েছিল দল। সে আরেক কাহিনি।
এরপর সুব্রতদার রাজনীতিতে কিছুদিন ভাটার টান। দেখা হয়েছে। আড্ডা হয়েছে।
সময়টা এমন যে তখন বামফ্রন্টের সংখ্যাগত রমরমা থাকলেও মমতাদির ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। সিঙ্গুরকে ঘিরে জমি আন্দোলন তুঙ্গে উঠছে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একের পর এক বিতর্কিত পদক্ষেপ এবং মন্তব্যে কোণঠাসা হচ্ছেন। জমি আন্দোলন ছড়াচ্ছে। সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম।
স্পষ্ট দেখেছি সুব্রতদা ছটফট করছেন।

আদ্যন্ত রাজনীতির লোক। কংগ্রেসে থেকে দু’একটা কর্মসূচিতে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু তাতে রাজনীতির খিদে মিটছে না। কারণ, মমতাদি ক্রমশ আন্দোলনের রাশ হাতে নিয়ে নিয়েছেন।
একদিন বিকেলে বেশ দীর্ঘ আড্ডা হল।
– ‘বুঝলে, সেদিন রাতের ওই সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। আসলে একদিন রাগের মাথায় ঝোঁকের মাথায় উল্টোদিকটা এতটাই সাজিয়ে ফেলেছিলাম যে আর পিছোতে পারিনি। তারপর ভোটের আগেই বুঝেছি কাগজের সমীক্ষা আর গ্রাউন্ড রিয়েলিটি এক নয়। তখন তো আর কিছু করার ছিল না।’
মমতাদির আন্দোলনের প্রশংসা করেছেন বারবার। —‘বলেছিলাম না, ও আবার ঠিক ধরে নেবে।’
মনে হচ্ছিল সুব্রতদার হাত-পা নিশপিশ করছে। পারলেই মমতাদির আন্দোলন কর্মসূচিতে চলে যান। কিন্তু বরফ গলছে না। সুব্রতদা যেভাবে যখন চলে গিয়েছিলেন, তৃণমূল পরিবার প্রবল রেগে। দিদি গভীর অভিমানে। সুব্রতদাও তখন কংগ্রেসের মঞ্চে।

আমি সুব্রতদার কথাগুলো ক্বচিৎ কদাচিৎ দিদিকে বলি।
তিনি থামিয়ে দেন না, সাড়াও দেন না।
জমি আন্দোলন তখন তীব্র।
ততদিনে সোমেন মিত্রও কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে।
মমতাদি-সোমেনদা বারবার বেশ শিরোনামে।
সোমেনদা যে তৃণমূলে আসতে পারেন, মমতাদির নেতৃত্ব মেনে রাজনীতিতে নতুন চমক দিতে পারেন এবং মমতাদিও দারুণ সম্মান দিয়ে উল্টো মেরুর সোমেনদাকে সঙ্গে রাখতে পারেন, এটাতে অনেকের কাছেই ছিল বিস্ময়ের।
আর এই ঘটনাটা বোধহয় সুব্রতদার উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ একটু বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে মমতাদির এতদিনের সম্পর্ক। তিনি দূরে। অথচ রেষারেষির সম্পর্কে থাকা সোমেনদা মমতাদির পাশে, তৃণমূলের মঞ্চে, এটা সুব্রতদার কাছে এক অবিরাম অস্থিরতার উপাদান হয়ে উঠেছিল।
জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সোমেনের ওখানে কাজ করতে অসুবিধে হচ্ছে না? সত্যি বলো তো।’
বলেছিলাম, ‘কই, সেরকম কিছু দেখছি না তো। দিব্যি আছেন। মমতাদিও যথেষ্ট সম্মান দেন।’
একই কথা খোদ সোমেনদাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সুব্রতদা। এক অনুষ্ঠানের বাড়িতে, আড্ডার মধ্যে।
-‘এতদিন মমতার বিরোধিতা করার পর তোমার ওখানে অ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধে হচ্ছে না?’ ঝকঝকে হাসিমুখে প্রশ্ন।

সোমেনদার মিষ্টি হাসিতে জবাব, ‘ওভাবে ভেবে আর লাভ নেই। মমতা মাস লিডার। মানুষ নিয়ে নিয়েছে ওকে। আমাদের তো বয়স হল। সিপিএমকে সরাতে না পারার দায় বহন করার ইচ্ছে আর নেই। মমতাকে সামনে রেখেই লড়াইটা হোক। তবে ওর উৎসাহের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন।’
সেদিন সুব্রতদা, সোমেনদা একটা জরুরি বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। তা হল, দিল্লির কংগ্রেস নয়ের দশকে যেভাবে বামেদের উপর নির্ভর করে চলত, সেই লাইন মানতে গিয়ে রাজ্য কংগ্রেসের বদনাম হয়েছে। দল ডুবেছে। আর আসল সিপিএম বিরোধিতার পতাকা চলে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে।
সোমেনদাও যখন প্রাণখুলে মমতাদির নেতৃত্বে তৃণমূল করছেন, সুব্রতদা তখন অনুভব করেছেন তাঁর অতীত জীবনের ডাকাবুকো ইমেজের স্মৃতি। মমতাদির সঙ্গে সুসম্পর্কটা মিস করছিলেন তিনি।
তাঁর মন চাইছিল তৃণমূলে ফিরে মমতাদির সঙ্গে আন্দোলনে নামতে। কিন্তু জট খুলছিল না।
তিনি সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
ডাকসাইটে ছাত্রনেতা, যুবনেতা, শ্রমিকনেতা। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানার কনিষ্ঠতম মন্ত্রী। দীর্ঘদিনের বিধায়ক। পরিষদীয় রাজনীতির দুঁদে খেলোয়াড়। বিতর্কিত মন্তব্যে শিরোনামে থাকার মাস্টারমশাই।
তিনি অভিজ্ঞ, বর্ণময় চরিত্র।
চব্বিশ ঘণ্টার রাজনীতিবিদ। রাজনীতির হাওয়া বোঝেন।
একটা সময়ে নিজের প্রাণাধিক প্রিয় দাদা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকেও ছেড়ে দিয়ে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন। অনেক পরে দলবদলের তকমা গায়ে লাগালেও সুব্রতদা এই সময়টা দেখতে পাচ্ছিলেন মমতাদির প্রবল কাম ব্যাক, উত্থান, তৃণমূলের প্রতি বাংলার সমর্থন।
মন খুলে কথা বললেন সুব্রতদা।
ঘটনাচক্রে কলকাতা নয়, লন্ডনে। হ্যারোতে। একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলাম আমরা। বউদিও গিয়েছিলেন।
একদিন সকালে হ্যারোতে হোটেলে বসে কথা শুরু হল আমাদের।
বউদির শান্তকণ্ঠে বিরক্তিপ্রকাশ, ‘লন্ডনে এসেও সেই কংগ্রেস আর তৃণমূল! তোমরা কী!!!! এগুলো তো কলকাতায় হতে পারত।’

হতে পারত তো বটে, কিন্তু সেদিন আবার পাক্কা একটি ঘণ্টা ওই লন্ডনে।
২০০৫-এ সুব্রতদার গড়িয়াহাটের বাড়িতে মাঝরাতে যে কথাগুলো সেবারের মতো শেষ হয়েছিল, ঠিক সেখান থেকেই যেন আবার খাতা খুলে কথা শুরু।
আমার সৌভাগ্য, এইরকম একজন রাজনৈতিক নক্ষত্রের মনবদলের সন্ধিক্ষণকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি বারবার। সুব্রতদা ভালবাসতেন, দিদি স্নেহ করতেন, সম্ভবত সেই কারণেই আমার কাছে মুখ খুলতেন এবং মনও খুলতেন।
হ্যারো হোটেলের লাউঞ্জে সুব্রতদা বলছেন। আমি শুনছি। বউদি মাঝে মাঝে উঠে বাইরের ছবিটা দেখে আসছেন।
সুব্রতদা এতদিন পর খোলাখুলিই বলেছিলেন, ‘তৃণমূলেই ফিরতে চাই। মমতার নেতৃত্বেই রাজনীতি করব। সেদিন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আসলে ঝোঁকের মাথায় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আর ফেরার পথ ছিল না। কিন্তু সেদিনও বলেছিলাম আবার মমতার আন্দোলনের মঞ্চেই ফিরব। সময়টা এসে গিয়েছে।’
আরও কিছু কথা হল।
তারপর দাদা, বউদি একটু ঘুরতে বেরোলেন।
আমরা হোটেলের সামনে ছবি তুললাম।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা না বললে অন্যায় হবে।
২০০৫-এর সেই শেষ বৈঠক এবং সেদিন বিলেতের হোটেলে বসে কথা, দুটোই সুব্রতদার রাজনৈতিক জীবনের দলবদলজনিত সন্ধিক্ষণপর্বের।

ছন্দবাণী বউদি দুটোতেই উপস্থিত ছিলেন, সবটা শুনেছেন, কিন্তু কী আশ্চর্য, দেরিজনিত বিরক্তিপ্রকাশ ছাড়া একটি রাজনৈতিক প্রসঙ্গে ন্যূনতম একটি কথাও বলেননি। বাকি সবেতে বউদি স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে একটি কথাও নয়। এমনকী সুব্রতদা যাই করুন, বউদি নিজে কী চান বা কোনও পরামর্শ আছে কি না, তা বোঝা অসম্ভব। মাথাটাও কোনওদিকে কখনও হেলাননি।
লন্ডনে কথার বিষয়বস্তু মমতাদিকে জানিয়েছিলাম যথাসময়ে।
তার বেশ কিছুদিন পর যখন সুব্রতদার তৃণমূলে ফেরার মুহূর্ত উপস্থিত, সেই দিনটা আরেক নাটকীয়তায় ভরা।
অত বড় মাপের একজন রাজনৈতিক মহানক্ষত্র তিনি। আমি বয়সে কত ছোট এবং যতই পরিচিতি পাই, তাঁর কাছে এক তুচ্ছ সংবাদকর্মী; আমারও মনে হয়েছিল সুব্রতদার মধ্যে অদ্ভুত একটা ছেলেমানুষি আছে। মনটা একদম সরল।
সুব্রতদার তৃণমূলে ফেরার দিনটা মনে থাকবে।
সকাল থেকেই সেদিন মেঘলা, বৃষ্টি।
(পরের পর্ব আসছে)

Previous articleনামছে তাপমাত্রা, রাজ্যজুড়ে কবে জাঁকিয়ে পড়বে শীত
Next articleছত্তিশগঢ়ে সহকর্মীর গুলিতে নিহত ৪ সিআরপিএফ জওয়ান,জখম ৩