Thursday, November 6, 2025

বাবা ছিলেন সামান্য এক গির্জার পাদ্রি। আয় নামমাত্র। এগারোটি সন্তানের জ্যেষ্ঠ সন্তান। খাবার জোগাতেই নাভিশ্বাস। ভাল স্কুলে পাঠানো তো দূরের কথা, চাইতেন এই পুত্রও যেন তাঁর মতো পাদ্রি হয়ে উঠুক। পেটটা তো চলবে। কিন্তু বিদ্যা অর্জন করার অদম্য ইচ্ছে যার মনে তাকে কে আটকাবে? মেধাবী ছাত্রটি একবার যা পড়ে তাইই মাথায় গেঁথে যায়। মনে অদম্য কৌতূহল। শুধু কি পড়াশোনা? খেলাধুলা-সহ সবেতেই প্রথম। জয়ই হল তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ কথা। কিন্তু জয় চাইলেই তো  জয় আসে না, চাই প্রতিনিয়ত নিজের প্রতি দায়বদ্ধতা, চাই চেষ্টা। সেই চেষ্টার ত্রুটি করেননি, নোবেলজয়ী কিংবদন্তি এই বিজ্ঞানী। মানব মনের জটিল রহস্যের উদ্ভাবনী বিজ্ঞানী পাভলভ। পুরো নাম আইভ্যান পেট্রোভিচ পাভলভ। জন্ম মস্কোর রিয়াজানা শহরে। ১৮৪৯ সালে। যাঁর গোটা জীবনই কেটেছে এক্সপেরিমেন্ট করে। বার বার বদল করছেন গবেষণার পথ ও ভাবনা। তাই তো তিনি নিজেই জীবনের স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন, ‘মাই হোল লাইভ হাজবিন ডিভটেডেট টু এক্সপেরিমেন্টেশন’।

আরও পড়ুনঃপ্রাণের উৎস সন্ধানে দৈত্য টেলিস্কোপের মহাশূন্যে যাত্রা

পরীক্ষা  আর পরীক্ষা। কখনও প্রজাপতির রঙিন ডানার রূপান্তরের কারণ তো কখনও হৃৎপিণ্ডের কাজকারবারে স্নায়ুনিয়ন্ত্রণ বা নার্ভাস কন্ট্রোল অব হার্ট অ্যাকশন। এক কথায় হৎপিণ্ডের পেশির সঙ্কোচন ও বিমোচন। রোমহর্ষক সব গবেষণায় কাল কাটিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। কখনও মেতে উঠেছেন শরীরে খাদ্যের হজমের শারীরবৃত্তীয় কারণে। বছরের পর বছর অনুসন্ধান চালিয়েই লিখেছিলেন ‘দ্য ওয়র্ক অব ডাইজেস্টিভ গ্ল্যান্ড’। এই প্রকাশিত বই-ই তাঁকে বিশ্বদরবারে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর জয়তিলক এঁকে দিয়েছে। এর আগে যে কাজ শুরু করেছিলেন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী শারীরতাত্ত্বিক ক্লাউড বার্নার্ড। ক্লাউড বার্নাডের অসমাপ্ত কাজই এগিয়ে নিয়ে গেছেন পাভলভ। প্রথম রুশ বিজ্ঞানী হিসেবে। অথচ পাভলভের পরিচিতি বেশি মানবমনের বিজ্ঞানী হিসেবেই ।

একজন পাদ্রি না হয়ে বিজ্ঞানকেই বেছে নিয়েছিলেন জীবনের গবেষণার প্রধান বিষয় হিসেবে। তিনি ঠিক করলেন পাদ্রি নয় বিজ্ঞানী হবেন। ধর্ম নয়, বিজ্ঞানই পারে তাঁর মনকে তৃপ্তি দিতে। বিজ্ঞানের ছাত্রাবস্থাতেই হাতে পেয়েছিলেন ডারউইনের অরিজিন অব স্ফিসিস বইটি। এই বইই পাভলভের জীবনে এক নতুন মোড় এনে দেয়। বিবর্তনের তত্ত্বের এই বই পড়েই স্থির করলেন বিজ্ঞানী হবেন। এই সময়েই ১৮৬০ সালে  অনুপ্রাণিত হয়েছেন রাশিয়ান ফিজিওলজির জনক ইভান সেচেনভ ও সাহিত্য সমালোচক দিমিত্রি পিসারেভের নানান রচনা পাঠ করে। স্থির করলেন ধর্মীয় কর্মজীবন ত্যাগ করে বিজ্ঞানে জীবন উৎসর্গ করবেন। সেই পথেই এগিয়ে ছিলেন।

২১ বছর বয়সে সেন্ট পিটর্সবার্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে শিক্ষক হিসেবে পেলেন মেন্ডেলিভের মতো জগদ্বিখ্যাত মাস্টারমশাইকে। এই শিক্ষকের হাতেই রসায়নে মৌল বিষয়ের পড়াশোনা। কিন্তু মন বসল না যুবক পাভলভের। তাঁর প্রিয় বিষয় শারীরবিদ্যার এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিওলজি। অধ্যাপক ইলিয়াকিয়নের কাছে নতুন করে শরীরের হজমতন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা । এই বিষয় নিয়ে ডুবে গেলেন গভীর পড়াশোনায়। পরীক্ষামূলক প্রায়োগিক শারীরবিদ্যাই হয়ে উঠল জীবনের ধ্যানজ্ঞান। পদার্থবিদ্যা ও গণিতের পাশাপাশি শারীরবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা। এই বিষয়ে গবেষণাপত্র লিখে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেলেন। ডাক পেলেন কনস্ট্যানটিন নিকোলভিচ উস্টিসোভিচের গবেষণাতে কাজ করার। বিখ্যাত রাশিয়ান চিকিৎসক এই প্রতিভাধর তরুণকে চিনতে ভুল করেননি।

শুরু করলেন ডাক্তারি পড়া। সুযোগ পেলেন পশুচিকিৎসা বিভাগে ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসবে কাজ। সেখানে ইচ্ছেমতো পরীক্ষানিরীক্ষা। অনন্ত কৌতূহল শরীরের পরিপাক প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি জানা।  অন্যদিকে, নিজস্ব গবেষণাগারে শূককীটের অবস্থা থেকে রঙিন প্রজাপতির বিবর্তন পরীক্ষায় মগ্ন। সেন্টপিটার্স বার্গের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ভবনের শারীরবিদ্যা বিভাগের প্রধান ডিরেক্টর হয়ে যোগ দিলেন চাকরিতে। অভাব দূর হল বটে, কিন্তু মন পড়ে রইল গবেষণায়। কখনওই এক জায়গায় থেমে থাকেননি, বারবার বদল করেছেন পথ। ১৯০৪ সালে চিকিৎসা ও শারীরবিদ্যার গবেষণাই তাঁকে বিশ্ববন্দিত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি দিল। যা আগেই বলা হয়েছে।

এরই মধ্যে মগ্ন ছিলেন জীবজন্তুর মস্তিষ্ক, প্রকৃতি ও তার কার্যকারিতা নিয়ে। মস্তিষ্কই যে শরীরের রাসায়নিক ক্রিয়াকাণ্ডের হেডমাস্টার— সেই দিকটাই গবেষণায় তুলে ধরেছেন।  বিজ্ঞানী মহলে পাভলভের নতুন ভাবনার নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আলোচনা। হজম প্রক্রিয়ার দিগন্তবিস্তারি গবেষণার পর মন দিলেন মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের খুঁটিনাটি জানতে। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘কন্ডিশনাল রিফ্লেক্স’। শারীরবিদদের কাছে যা ছিল অনেকটাই ধোঁয়াশা। পাভলভ তাঁর গবেষণায় তুলে আনলেন বিষয়টি। একটি কুকুরের ওপর গবেষণা চালালেন। নির্দিষ্ট সময়ে ঘণ্টা বাজিয়ে তাকে খাবারের সময় বোঝানো ও তার জিহ্বা থেকে লালারস নিঃসরণ। এই বিখ্যাত আবিষ্কার রাতারাতি বিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন তুলেছিল।

সেখানেই থেমে থাকেননি, শুধু মস্তিষ্ক নয়, মানব মনের অসুখের সন্ধানেও চালালেন গবেষণা। মস্তিষ্কের রহস্যময় জগতের কাজকারবার থেকে শুরু করে মনের অসুখের খুঁটিনাটি জানা। যাকে বলা যায় কনডিশনাল রিফ্লেকশন থেকে সাইকিয়াট্রির দিকে এগনো। নতুন পথ। যা বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। নিউরোসিস, বা স্নায়ুরোগের কারণ নিয়ে তাঁর সাড়াজাগানো গবেষণাই মানবমনের নানান জটিলতার অনেক নতুন দিক উদ্ভাবিত হল। মানবমনের এক অবিসংবাদিত বিজ্ঞানী-গবেষক হিসেবে পাভলভ জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেলেন। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে পাদ্রি হোক, কিন্তু পুত্র বিজ্ঞানের পথেই হেঁটেছেন এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন হয়েছেন।

উল্লেখ্য, ২০০২ সালে প্রকাশিত জেনারেল সাইকোলজির রিভিউতে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বিংশ শতকের ২৪তম বিশ্বখ্যাত মনোবিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচিত হন তিনি।

Related articles

হরিয়ানায় ভোটার জালিয়াতি: প্রকাশ্যে এসে ব্রাজিলিয়ান ‘মডেল’ বললেন, ভারতেই যাইনি কোনওদিন

হরিয়ানায় ভোটার জালিয়াতিতে যার ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে অভিযোগ, সেই ব্রাজিলিয়ান মডেলের (Brazilian  Model) নাম 'ল্যারিসা'। এবার...

লালবাজারে কাছে গাড়ির টুলসের গোডাউনে আগুন, ঘটনাস্থলে দমকলের ৫ ইঞ্জিন

শহর কলকাতায় ফের অগ্নিকাণ্ড (Fire breaks Out in Kolkata)। বৃহস্পতিবার সকালে লালবাজারের কাছে ২১ নম্বর আর এন মুখার্জি...

সকালে শীতের আমেজ, রাতে পারদ পতনের সম্ভাবনা!

শীতের (Winter) অফিশিয়াল ঘোষণা হোক বা না হোক নভেম্বরের গোড়া থেকেই সকাল রাতে প্রকৃতির হিমেল ছোঁয়ায় শিহরিত হচ্ছে...

তারাসুন্দরীর মঞ্চে ম্যাজিক দেখালেন গার্গী

কুণাল ঘোষ বাংলার নাট্যমঞ্চে ইতিহাসের পাতাকে পুনরুজ্জীবিত করেই এক নতুন ইতিহাস লেখা হল। লিখলেন অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী (Gargi Raychowdhuri),...
Exit mobile version