ইউক্রেনে কেন ডাক্তার হতে যাওয়া? একবার ভেবে দেখেছেন!

দেবাশিস বিশ্বাস

আনিস কান্ড ডানা মেলতে না মেলতে পুতিন সাহেব ফেলতে শুরু করলো তার ভাইয়ের দেশে বোমা। বোম পড়তে না পড়তেই আমরা কে দোষী বুঝে উঠতে নেমে পড়লাম। তারপর কে কোন পক্ষ নেব এই ভেবে আকুল। পরে দেখা গেল এই গোলমালে ভারত এক আদর ব্যাপারী, জাহাজঘাটায় কবে জাহাজ ভিড়বে সে খবর তার না রাখলেও চলে। এতে মোচলমান পেদানির রস ও নেই। তাই টিভিতে নানান রঙের বোমা তুবড়ি দেখায় মন দিলাম।

 

আচমকা রসভঙ্গ। শুনলাম যে ওই ইউক্রেন (Ukraine) এ (সে দেশটা যে কোথায় তাই অনেকে জানেনা) নাকি এই সকল দেশের রানির প্রায় ২৫ হাজার সন্তান উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে, এবং তারা চরম বিপদে পড়ে গেছে। এ যেন বিরাট বিস্ময়। এ কি দেখছি, থুড়ি শুনছি? এই দেশের ছাত্ররা জ্ঞান লাভের আশায় অত দূরে যাচ্ছে? এ তো বিরাট গর্বের বিষয়। নাহ আমি একদমই আপডেটেড নই। জ্ঞান তৃষ্ণার জন্য অতীতে ভারতীয়রা কত দুর্গম জায়গায় চলে যেত। অতীশ দীপঙ্কর তো অনেক আগে, এমন কি রামমোহন অব্দি প্রায় পায়ে হেঁটেই দুর্গম তিব্বত গেছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষার জন্য। আরও বহু মানুষ গিয়েছেন। সেই ধারা আজ ও কি জারি আছে, যার খবর আমরা পাইনা। আমাদের সন্তান সন্ততিরা জ্ঞান লাভের জন্য ইউক্রেন? কী পড়ে তারা? নিশ্চয় ইউক্রেন বা রাশিয়া বা সমগ্র বলকান অঞ্চলের ইতিহাস, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, প্রত্নতত্ব বা নৃতত্ত্ব এমন কিছুই হবে। নিদেন পক্ষে সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতি। এতো জ্ঞান তৃষ্ণা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভেবে গর্বে বুক ৬৫ ইঞ্চি হবার উপক্রম। উফ্ যেন ভাবতেই পারছি না। বেশ একটা ঘোর লেগে যাবার উপক্রম। এরাই তো বিদেশে ভারতের মুখ।

আরও পড়ুন: অস্ত্রপচারের সময় রক্তচাপের ওঠানামা যেন ‘জোয়ার ভাটা’, রোগ সারালেন কলকাতার চিকিৎসকরা

এরপর পড়লো আর এক বোমা। জানতে পারলাম এরা কেউ রাশিয়া বা ইউক্রেনের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস নিয়ে উচ্চ শিক্ষা বা গবেষনা করতে যায় না। এরা যায় ডাক্তারি পড়তে, এবং তাও স্নাতক স্তরে। এবার কেমন যেন ধন্ধ লাগলো। এ কেমন ব্যাপার। ইউক্রেন বা রাশিয়া তো চিকিৎসায় ভারতের থেকে উন্নত এমন কথা শুনিনি। আগে শুনতাম বিলেত ফেরত ডাক্তার। সাধারন ডাক্তার যদি ১০ টাকা ফি হয় তো বিলেত ফেরত হলে ৩৫ টাকা। তো এখন কি ইউক্রেন ফেরত গজিয়েছে? তাও বিলেতে লোকে যেত বা এখনও যায় চিকিৎসায় উচ্চ শিক্ষার জন্য। এরকম স্নাতক হতে নয়। তাহলে এটা কি? একটু তলিয়ে দেখতে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে মাথা খারাপ হবার লক্ষণ। সংক্ষেপে বলি–

১. রাশিয়া বা ইউক্রেনে (Ukraine) ডাক্তারি পড়তে কোনও পরীক্ষা দিতে হয় না। টাকা থাকলে যে কেউ পড়তে পারে।

২. পড়ার খরচ? বছরে ৮-১০ লক্ষ টাকা। হ্যাঁ মশাই গাঁজা খাইনি সকালে। ওটা প্রতি বছরেই লাগে, এর থেকে বেশীও লাগতে পারে। এছাড়া ওই দেশে খাওয়া বসবাস, সেও প্রায় বছরে ২ লাখ টাকার মতন। ভিরমি খাচ্ছেন তো? আমিও খেয়েছি। ওই প্রতি বছরের খরচের তিন বা চার ভাগ খরচে আমার কন্যার নার্সারি থেকে মাস্টার্স অবধি পড়াশুনা হয়ে গেল। নাকি সে মূর্খ হল কে জানে।

৩. ভাবছেন যারা পড়ে তারা নিশ্চয় রাজা বাদশা বা মাফিয়া। ভুল, পুরো ভুল। ওখানে যারা পড়ে তারা আমার আপনার মতন সাধারণ মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়ির। এবং এই বিপুল অর্থের বেশিরভাগ ই ঋণ বা ধার। এবং যেহেতু কোনও ভাল ব্যাঙ্ক এসব জায়গায় পড়ার জন্য লোন দেয় না, তাই নানা আজগুবি আর্থিক সংস্থার কাছে নিতে হয় অতি চড়া সুদে ঋণ। এই কথাটা কর্ণাটকের হতভাগ্য মৃত ছাত্রটির বাবাই সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছে। ছেলেকে চার বছর পড়াতে তার প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা দেনা হয়েছে, জমি বিক্রি করতে হয়েছে। ছেলে পাস করে আসলে হয়তো সুরাহা হত, এখন কী হবে তারা ভেবে পাচ্ছেন না।

৪. এই ভর্তির প্রক্রিয়া থেকে টাকার ব্যবস্থা, পাসপোর্ট, ভিসা, হোস্টেল, কলেজ অ্যাডমিশন সবটা করে দেবার জন্য প্রভূত দালাল বা আড়কাঠি আছে। যারা নানান কেরিয়ার কাউন্সিলরের নামে ব্যবসা খুলে ছাত্র এবং অভিভাবকদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে, তাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। বলা বাহুল্য এই বিপদের সময় তাদের টিকি নেই। এদের ধরে পেটানো উচিত।

৫. এই যারা রাশিয়া পড়তে যায় এত কষ্ট করে বা এত খরচ করে, তারা কি বিরাট বিরাট ডাক্তার হয়? আজ্ঞে না। তাদের এদেশে ফিরে চিকিৎসা করতে গেলে এক কঠিন পরীক্ষায় পাস করতে হয়। না হলে এই দেশের registration number পাওয়া যায় না। এবং সেই পরীক্ষা অতি অতি কঠিন। ১০০ জনের মধ্যে ১০-১৫ জন পাস করতে পারে। আর এই পরীক্ষা দেওয়া যায় মাত্র দু’বার। বলা বাহুল্য ৮০ শতাংশ ছাত্রর জীবনে আর আইনি চিকিৎসা করার সুযোগ হয়না। এরা হারিয়ে যায় নানান অসামাজিক, অনৈতিক, বেআইনি কাজ কর্মের পঙ্কিল আবর্তে। বেশিরভাগ illegal abortion করায়। বা ঘুমের ওষুধের prescription লেখে। কেউ কেউ বেআইনি ভাবে গর্ভস্থ শিশু পুরুষ না স্ত্রী এই খোঁজ দিয়ে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করে। আরও বহু অন্যায় কাজ করে বা করতে বাধ্য হয়, এসব এখানে লিখলাম না। কেউ কেউ বাবাজি বা গুরুজি সেজে নানা অসুখের দৈব ওষুধ দেয়।

বোঝাই যাচ্ছে, এই ছেলে মেয়েগুলি কোনও জ্ঞান বা উচ্চ শিক্ষাভিলাশের বলি নয়, এরা উচ্চাশা (নিজের বা পরিবারের) এবং অর্থ পিপাসার বলি। অসুস্থ এই সমাজের গর্ভে জন্ম নেওয়া অতি অসুস্থ পঙ্গু ভবিষ্যত প্রজন্ম। ছাত্রদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা তো করতেই হবে, হয়তো তারা ফিরবেও। কিন্তু তার থেকে বহুগুণ বেশি দরকার ছাত্রদের ছাত্রাবস্থা ফিরিয়ে দেওয়া, শিক্ষাকে ফিরিয়ে দেওয়া জ্ঞানের পথে। সে কাজ বড় কঠিন। তার চেয়ে ছাত্রদের ফেরানোর দাবিতে হৈ-হল্লা করা বেশি সহজ।

হতভাগ্য এই দেশ।

 

Previous articleRussia-eucrain : ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয় পড়ুয়াদের জন্য নয়া নির্দেশিকা বিদেশ মন্ত্রকের
Next articleমানবিক করিডর করে সাধারণ নাগরিকদের সরাতে রাজি রাশিয়া ও ইউক্রেন