খোল দ্বার, খোল লাগল যে দোল…

আকাশের রঙ আজ নীল। গাছে গাছে ফুটেছে পলাশ । শাল-পিয়ালের বনে ধূসর বর্ণহীন পাতা ঝরে গিয়ে গাছের শাখাগুলো ঢেকে যাচ্ছে কচি কচি নতুন পাতায়। আকাশে বাতাসে আজ শুধুই বসন্তের গন্ধ। শীতের রুক্ষ দিনের অবসান ঘটিয়ে ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’! আর বসন্ত কালকে হরেকরকম রঙে রঙিন করে তুলেছে যে উৎসব,তা হল বসন্ত উৎসব বা দোলোৎসব বা হোলি। নতুনের দিশারি এই উৎসবে রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। রুক্ষতাকে দূরে সরিয়ে চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে, “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল/ স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল, দ্বার খোল দ্বার খোল।”

আজ দোল। বসন্তের শেষলগ্নে রঙের উৎসবে রঙিন হয়ে ওঠার দিন আজ। দোল বা হোলি উৎসব ভারতে কবে প্রচলিত হয়েছিল, সেই সন-তারিখ নিয়ে কচকচানিতে না যাওয়ায় ভালো। তবে বলা ভালো বেদ, পুরাণ, শব্দপুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ, মহর্ষি জৈমিনির মীমাংসা সূত্র প্রভৃতিতে হোলি উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই হোলি উৎসব প্রচলিত হয়েছিল বলে অনুমান। পুরাণ মতে বিবাহিতা মহিলারা পূর্ণ চন্দ্রকে পূজা করতেন সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য। পরবর্তী যুগে আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে এই উৎসবটি পালিত হতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে বসন্ত-মহোৎসব কিংবা কাম-মহোৎসবের প্রতীক!

আরও পড়ুন:বসন্তের রঙ লাগলো আইনসভার অন্দরেও, অধ্যক্ষের অনুরোধে গান গাইলেন অদিতি

রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী ঠাকুরবাড়ির দোল উৎসব সম্পর্কে লিখেছেন, “দোলপূর্ণিমারও একটি বিশেষ সাজ ছিল। সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে, আবিরের লাল রং সাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।” কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে সে দিন ধ্বনিত হত:
‘ওরে আয়রে তবে
মাতরে সবে আনন্দে
আজ নবীন প্রাণের বসন্তে
পিছনপানের বাঁধন হতে
চল ছুটে আজ বন্যাস্রোতে
আপনাকে আজ দখিন হাওয়ায়
ছড়িয়ে দে রে দিগন্তে…।’
শান্তিনিকেতনে এই দোলখেলা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে ‘বসন্ত উৎসব’ হিসেবে এক অসাধারণ ও অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। সে দিন শান্তিনিকেতনে মেয়েরা হলুদ শাড়িতে, চুলে লাল পলাশফুল দিয়ে নিজেদের সাজিয়ে তোলে। শাল শিমুল পলাশে ঘেরা শান্তিনিকেতনের অনন্যসাধারণ প্রকৃতিতে সঙ্গীত আর আবিরের ছোঁয়া লেগে রঙিন হয়ে ওঠে চারিদিক। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’। যদিও এবারে সেখানে বন্ধ বসন্ত উৎসব।

প্রেমিক-প্রেমিকা রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলার স্মৃতিকে কেন্দ্র করে যেমন আজও ফাগুন রঙে রঙিন হয়ে ওঠে বৃন্দাবন।

এই উৎসব বাস্তিকভাবেই শীতের রুক্ষতাকে বিদায় জানিয়ে রঙিন জীবনের পথচলা শুরু করা শেখায়। বসন্তকাল আমাদের নতুন ভাবে বাঁচতে সাহায্য করে, নতুন উৎসাহ জোগায় আমাদের অন্তরে। সে জন্যই হৃদয় বলে ওঠে, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে/ ময়ূরের মতো নাচেরে।’

দোলপূর্ণিমার এই পুণ্যলগ্নে নবদ্বীপের গঙ্গাপাড়ে জন্মেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। হরিপ্রেমে মাতোয়ারা, হরিনামে উন্মত্ত শ্রীচৈতন্য এই দিনে জন্মেছিলেন বলেই এই ফাল্গুনী পূর্ণিমার দোলের দিনটিকে ‘গৌরপূর্ণিমা’ও বলা হত। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং শ্রীগদাধর পণ্ডিত দোলায় চড়েছিলেন ও তাঁদের অনুগামী ভক্তবৃন্দ তাঁদের আবির কুমকুমে মাখিয়ে ভক্তি সহকারে পূজা করেছিলেন। এই অসাধারণ সুমধুর ঘটনাটিকে ‘হিন্দোলিকা বিহার’ বলা হয়। আজও নবদ্বীপ ও মায়াপুরের ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস বা ‘ইসকন’ সংস্থাটি পৃথিবীর যত জায়গায় তাদের শাখা সংগঠন আছে সর্বত্রই দোল উৎসব পালিত হয় মহা সমারোহে।

Previous articleBangladeshi Tourist Visa : স্থগিত ট্যুরিস্ট ভিসায় যাওয়া যাবে ভারতে
Next articleBreakfast News:ব্রেকফাস্ট নিউজ