ভুলেও কোরো না ভুল, উৎপল সিনহার কলম

মেয়েটি ও ছেলেটি। ভালোবাসে একে অপরকে।
দুজনে পরস্পরকে চোখে হারায়। পথেঘাটে সবসময় সর্বত্র একসাথে। পাড়াপড়শির আলোচনার মুখরোচক বিষয় ওদের অবিচ্ছিন্ন জুটি। কিন্তু দুজনের বাড়িই ওদের ভালোবাসাকে অনুমোদন দেয় না। বরং বিরুদ্ধতার চাবুক কষায়। এইভাবে চলতে চলতে একসময় ওরা অসহায় বোধ করতে থাকে। দুজনেরই কোনো রোজগার নেই। সংসার থেকে পৃথক হয়ে অন‍্যত্র বাসা বাঁধা ও অন্নসংস্থানের উপায় নেই ওদের। তাই পরজন্মে আবার মিলিত হওয়ার অঙ্গীকার ক’রে ওরা আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কথা হয় মেয়েটি ও ছেলেটি যে যার নিজের ঘরে একটি নির্দিষ্ট দিনে নিজেদের শেষ ক’রে দেবে। কয়েকদিন পরে জানা যায় মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু ছেলেটি যে কোনো কারণেই হোক আত্মহত‍্যা করতে পারে নি।
বছর ঘুরতেই ছেলেটি চাকরি পেলো। আরও বছরখানেক পরে সে বিয়ে করলো এক পরমাসুন্দরীকে। অন্ধপ্রেমে অকালমৃত হতভাগ্য মেয়েটি এসব জানতেও পারলো না।
সে তার প্রেমিকের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের সামান্য হদিশ যদি পেতো তাহলে কি নিজের সম্ভাবনাময় অমূল্য জীবনটির এমন অকারণ অপচয় করতো? অবশ্যই এর উল্টো ঘটনাও অনেক দেখা যায় শুধুমাত্র আমাদের সমাজেই নয়, সারাদেশে ও সারা পৃথিবীতেই। মেয়েটি বেঁচে রইলো, ছেলেটি চলে গেল।
একটা জীবন, মাত্র একটাই জীবন। এর চেয়ে মূল‍্যবান আর কিছুই হতে পারে না এটা কিছুতেই বুঝতে চায় না আত্মহননকামীরা। আর, প্রাণঘাতী ভুল একবার ক’রে ফেললে সেখান থেকে ফেরার আর কোনো পথ নেই।

এ প্রসঙ্গে একালের কবি কী বলছেন একটু দেখে নেওয়া যাক।
‘ সেও তো অনেক চৈত্রমাস —
সর্বনাশের পায়ে
গড়িয়ে পড়ত দু’জন ওরা
সন্ধে পাড়াগাঁয়ে

তারপরে তো গল্প একই —
দুইজনা দুই ঘরে —
মধ‍্যে একটা সমুদ্রজল
ওলটপালট করে

যদিও আমি এই কাহিনীর
সহস্র দোষ পাই
এই ঘটনায় যুক্ত আমার
সমস্ত বোন-ভাই

ওদের ফাটল ভরাট করতে
আমার লেখার সাঁকো
পেতে দিলাম খাদের ওপর,
একবার পা রাখো,

ভাঙবে জেনেও ‘না’ বলিনা —
ভাঙন এসে পড়ে
কিন্তু ওরা দাঁড়িয়ে থাকে
পাকিয়ে ওঠা ঝড়ে

সমাজ যখন বিরুদ্ধে যায়,
ঘা লাগে বিশ্বাসে —
চৈত্র নিজে এসে দাঁড়ান
সম্পর্কের পাশে

পথের শিবদুর্গাকে দেন
কবির কানাকড়ি
আমার সমর্থনের খাতা
রৌদ্রে তুলে ধরি!
( চৈত্র, বারোমাসের জগৎবাড়ি, জয় গোস্বামী )

কিন্তু, আমরা কী দেখতে পাই? দেখি চৈত্র ও কবির সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বাড়ি, আত্মীয়স্বজন ও সমাজের লাগাতার বিরুদ্ধাচরণ পবিত্র ভালোবাসাকে ঠেলে দেয় নৈরাশ‍্যের অতল অন্ধকারে। স্বপ্নসাধগুলোকে দলিত মথিত ক’রে একেবারে পিষে ফেলে। ঘটনা তখন এগোতে থাকে অঘটন ও দুর্ঘটনার দিকে।

শুধু প্রেম-ভালোবাসার কারণেই যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে তা তো নয়। আরও অনেক কারণেই একক, যুগল এমনকি সপরিবার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণগুলিকে এড়িয়ে গেলে চলবে না। জীবনের এই অপরিসীম অপচয় যেন অপ্রতিরোধ‍্য হয়ে ওঠে কখনো কখনো। মানুষের জটিল মনের ততোধিক জটিল বিন‍্যাস বোঝা সাধারণের পক্ষে তো বটেই, এমনকি মনস্তত্ত্ববিদের পক্ষেও দুরুহ হয়ে পড়ে অনেক সময়।


ফুলের মতো ফুটে থাকা সহজ সরল মনগুলো কখন কোন্ নৃশংস আঘাতে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে দিনের পর দিন কেউ জানতেই পারে না। তারপর একদিন যখন কোনো একটি ফুল অকালে ঝরে পড়ে তখন পোস্টমর্টেম হয়, কী ক’রে কী হলো এবং কী হ’লে কী হ’তে পারতো তা নিয়ে তুফান ওঠে চায়ের কাপে। মনে হয় কতই না সংবেদনশীল আমাদের সাধের সমাজ!
তারপর?
‘ এরকম ঘটেই থাকে
ভেবে লোক কষ্ট তাড়ায়

কিছুদিন স্থির থাকে জল
ছবিও দেয় অবিকল
কবে ফের মত্ত মাদল
সে জলের গ্রাসকে নাড়ায়…’
( মেয়েদের পাড়ায় পাড়ায়,
শঙ্খ ঘোষ )

কিশোর কুমার গেয়েছেন,
‘ নাই নাই
এ আঁধার থেকে
ফেরার পথ নাই…

আঁধার কি শুধু নিকষ কালো?
আঁধারের কি একটাই রং? আঁধারের কি কোনো রকমফের নেই? আছে।
আছে নানান রঙের আঁধার। নানান ধরন। এক এক পরিস্থিতিতে একেকরকম চরিত্র আঁধারের।
কোথায় এর শেষ? কোথায় সমাধান? কোথায় উপযুক্ত শুশ্রূষা?
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘ মন যে কেমন করে মনে মনে
তাহা মনই জানে…
লিখেছেন,
‘ হেথা কেহ কারো মন বোঝে না… ‘

সাধ ক’রে কে-ই বা মরতে চায় এই সুন্দর ভুবনে! লাশকাটা ঘরে কি কেউ যেতে চায় স্বেচ্ছায়?
জীবনানন্দ লিখেছেন,
‘ তবুও তো পেঁচা জাগে ;
গলিত স্থবির ব‍্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি
প্রভাতের ইশারায় — অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।…’

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা ক’রে আমাদের ক্লান্ত ক’রে দেওয়া বিপন্ন বিস্ময় শুধু নয়, ইদানিং উচ্চাকাঙ্খাজনিত ব‍্যর্থতার কারণেও আত্মঘাত ভীষণ বেড়ে গেছে। যেভাবেই হোক টিকে থাকার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় ইঁদুরদৌড়ে তথাকথিত ব‍্যর্থতার চরম গ্লানি তরুণ প্রজন্মের অনেককেই ঠেলে দিচ্ছে আত্মহননের দিকে।

সত‍্যিই কি এ আঁধার থেকে ফেরার পথ নেই?
আছে।
পথ একটাই।
আমাদের সবাইকে হ’য়ে উঠতে হবে আরও অনেক বেশি মানবিক ও সংবেদনশীল। আরও অনেক বেশি সহনশীল ও সতর্ক। সমীক্ষায় দেখা গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যাকামী তার বন্ধু ও আপনজনের কাছে তার গোপন বিদায়-সিদ্ধান্তের সঙ্কেত দেয় কোনো না কোনোভাবে। কিন্তু সে বেঁচে থাকতে সেইসব সঙ্কেত ধরা পড়ে না। তার অকাল-বিদায়ের পরে সকলে হায় হায় করতে থাকে।

আজকের দ্রুতগামী স্বার্থপর সময় প্রতি মুহূর্তে মানুষকে একা থাকার ও শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়ে চলেছে। যেন সবসময় কেউ সবার কানে কানে বলছে, বিচ্ছিন্ন হও, আরো আরও বিচ্ছিন্ন হও, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হ’য়ে একা একা বাঁচো।

আরও পড়ুন- নতুন সংসদ ভবনে হবে চলতি বছরের শীতকালীন অধিবেশন, জানালেন লোকসভার স্পিকার

অন‍্যের বিষাদ-বেদনা, চরম সঙ্কট ও বিদায়-সঙ্কেত বুঝতে হলে আমাদের সকলকেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে বেরিয়ে এসে পরার্থপরতা শিখতে হবে এবং সেটি শিখতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচার নিবিড় অনুশীলন।

 

Previous articleনতুন সংসদ ভবনে হবে চলতি বছরের শীতকালীন অধিবেশন, জানালেন লোকসভার স্পিকার
Next articleঅসমে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, পাশে থাকার আশ্বাস মোদির