জীবনপুরের পথিক: তরুণ মজুমদার (১৯৩১- ২০২২)

কিং মেকার হয়তো এই ধরনের মানুষদেরই বলা হয়। যেমন ছিলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার (Tarun Majumdar)। নবাগত, স্বল্প পরিচিতদের হাত ধরে পর্দায় নিয়ে এসে তিনি বিখ্যাত করে দিতেন। আর বাঙালি পাশের বাড়ির ছেলে মেয়েদের দেখত ছবির পর্দার নায়ক-নায়িকা হিসেবে। বাংলা ছায়াছবি জগতের অন্যতম জনপ্রিয় পরিচালক। র্দীর্ঘদিন  রোগভোগের সঙ্গে লড়াইয়ের পর চিরবিদায় নিলেন। এই কিংবদন্তি পরিচালক।

জন্ম ১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে। তাঁর বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারত সরকার এই প্রথিতযশা চিত্রপরিচালককে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। এ ছাড়াও তরুণ মজুমদার চার বার জাতীয় পুরস্কার, সাত বার বিএফজেএ পুরস্কার,  চার বার ফিল্মফেয়ার (Film Fare) পুরস্কার  এবং আনন্দলোক পুরস্কারেও সম্মনিতে হয়েছেন। তাঁর প্রথম ছবি ‘চাওয়া পাওয়া’। সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার (Uttam Kumar) এবং সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen)। যদিও সেই ছবিতে তরুণবাবু একা নন, আরও দুই পরিচালক একত্রে কাজ করেছিলেন।  শচীন মুখোপাধ্যায় এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে ‘যাত্রিক’ নামে টিম তৈরি করে সিনেমা পরিচালনার কাজ শুরু করেছিলেন। পরে ‘যাত্রিক’ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেই পরিচালনার কাজ শুরু করলেন। একা পথ চলা শুরু করলেন।  সেই শুরু। এরপর একে একে বহু জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত ছবি জন্ম নিয়েছে তরুণবাবুর ক্যামেরার মাধ্যমে। তরুণ মজুমদারের ভাবনায় গ্রাম বাংলা, সাধারণ জীবন প্রাণময়-মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বার বার নিজের কাজের মাধ্যমে এর প্রমাণ তিনি রেখেছিলেন। মানব জীবনের ছোট ছোট ঘটনাকে অসাধারণ বাঙ্ময় করে তুলতে পারতেন তরুণবাবু। মিষ্টি প্রেমের ছবি তৈরিতে তিনি ছিলেন এক সার্থক জাদুকর। ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘কুহেলি’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, ‘আপন আমার আপন’, ‘কাচের স্বর্গ’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘গণদেবতা’, ‘আলো’ তরুণ মজুমদারের বিখ্যাত কীর্তি। ১৯৬২ সালে ‘কাচের স্বর্গ’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।

বাংলার একাধিক নতুন মুখকে ‘শিল্পী’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন তিনি। সন্ধ্যা রায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, তাপস পাল, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়দৃর ‘জন্মদাতা’ ছিলেন তিনি। নতুনদের কীভাবে কাজ শিখিয়ে নিতে হয়, কীভাবে তাদের থেকে সেরাটা বের করে নিতে হয়, কীভাবে ক্যামেরার ভয় ভাঙিয়ে তাদের সাবলীল অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসাবে গড়ে তুলতে হয় তা জানতেন তরুণবাবু। তাই দাদার কীর্তি, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, বালিকা বধূ এই ছবিগুলিতে আনকোরা শিল্পীদের নিয়েও ব্লক বাস্টার ছবি তৈরি করেছিলেন তরুণ মজুমদার।

তরুণ মজুমদারের ছবিতে গানের ব্যবহার অবশ্যই আলাদা করে প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর প্রতিটি ছবিতেই গান  অন্য এক মাত্রা যোগ করেছিল। আর আদ্যন্ত রবীন্দ্রপ্রেমী তরুণবাবু তাঁর নিজের একাধিক ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সার্থক চিত্রায়ণ করেছিলেন। সে ‘দাদার কীর্তি’ ছবিই হোক ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ হোক বা ‘আলো’। রবি ঠাকুরের গান যেন তরুণ মজুমদারের ছবির প্রাণ হয়ে উঠেছিল।

ছায়াছবির জগতের মানুষ হলেও তরুণ মজুমদার কিন্তু আদতে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন।  স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে রসায়ন নিয়ে পাস করেন তরুণ বাবু।  তবে সিনেমার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক তাঁকে ছবির জগতে নিয়ে আসে।

শুধু ছায়াছবি এবং রসায়নই নয়, তরুণ মজুমদারের জীবনে বামপন্থা-আন্দোলনের গুরূত্বও ছিল অপরিসীম।  বরাবরই স্বাধীনচেতা, স্পষ্টবক্তা ছিলেন তিনি। ন্যায্য দাবি নিয়ে সোচ্চার হতে কখনো পিছপা হননি তিনি। বামপন্থা ছিল তাঁর রক্তে। বহুবার তরুণবাবু একাধিক ইস্যুতে বাম সমর্থক হিসেবে পথে নেমেছিলেন। বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। বার্ধক্যে শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তরুণবাবু বাম সমর্থক হিসেবে রাজপথে পা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুন:তরুণ মজুমদারের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

 

Previous articleতরুণ মজুমদারের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
Next articleআস্থা ভোটে জয়ী শিন্ডে শিবির, “৬ মাসও টিকবে না সরকার”, বার্তা পাওয়ারের