ইস্ট-মোহন ভারত-পাক, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

এদিকে গোল দেখতে গিয়ে যদি ওদিকে উইকেট পড়ে যায়? সেঞ্চুরি দেখতে গিয়ে যদি পেনাল্ট মিস হয়ে যায়?

হাওয়ায় ভাসানো অসাধারণ কর্নার দেখতে গিয়ে যদি ফ্রন্টফুটে মারা অনবদ্য ছক্কা দেখতে না পাই? ফ্রি-কিকটা না দেখলেই নয়, কিন্তু মাখনের মধ‍্যে ছুরি চালানোর মত শিল্পময় স্কোয়ার কাট থেকে চোখ সরানোই যে মুশকিল! আর থ্রু পাস? ডিফেন্স চেরা অপরূপা থ্রু, যা থেকে গোল না করতে পারা মহা অপরাধ, যা দেখে চোখ জুড়োয়, জীবন সার্থক হয়।

উঃ, কী যে নিদারুণ সমস্যা! কেন যে একই দিনে প্রায় একই সময়ে এই দুটো খেলা একসঙ্গে পড়ে!

মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল । ভারত বনাম পাকিস্তান। একই দিনে ফুটবল ও ক্রিকেট । ধুন্ধুমার ম‍্যাচ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বিনা যুদ্ধে যেখানে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়ে না। ডার্বি, গোলাপের যুদ্ধ, বড় ম‍্যাচ,কত যে নাম। যে কোনো একটা ম‍্যাচ হলেই উত্তেজনার চূড়ান্ত। টগবগ ফুটতে থাকেন সমর্থকেরা। মাঠে নামার আগেই তর্কযুদ্ধ। চায়ের কাপে তুফান।

একটাতেই রেহাই নেই, তায় আবার একই দিনে দু’দুটো হাই ভোল্টেজ ম‍্যাচ? তাও আবার প্রায় একই সময়ে? বেজে ওঠে রণদামামা। খেলাপাগলদের কাছে এমন দিন একেবারে স্বপ্নের মতো। আনন্দে আশঙ্কায় ঘুম ছুটে যায়। একই দিনে এই দুটো ম‍্যাচ থাকলে বাগান সমর্থকেরা চান বাগান ও ভারতের জয়। তাহলে আর কোনো দুঃখ থাকে না। একই সন্ধ্যায় দু’দুটো যুদ্ধজয়ের পর গলদা চিংড়ি ও মাটন বিরিয়ানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে গভীর ঘুমে রাত কাবার। মনে পরম প্রশান্তি।

আরও পড়ুন- ঘুরে দাঁড়ানোর সহজ পাঠ, উৎপল সিনহার কলম

ইস্ট সমর্থকেরা চান উল্টোটা। তবে ভারতের জয়টা দু’পক্ষেরই কমন চাহিদা। তাহলেই কেল্লা ফতে। রাতের ভুরিভোজে ইলিশের পঞ্চপদ কে রোখে তখন! আহা, জলের রূপোলী শষ‍্য!

কিন্তু, একই দিনে এই দুটো মহার্ঘ‍্য খেলা থাকলে ভীষণ মুশকিল হয় তাঁদের যাঁরা ফুটবল ও ক্রিকেট দুটো খেলাই পাগলের মতো ভালোবাসেন। তাঁরা ভেবে পান না কোনটা ছেড়ে কোনটা বেছে নেবেন। এধারে থাকবো, নাকি ওধারে যাবো? কী করা উচিত? কী যে করি! কী করি আজ ভেবে না পাই…
হায়, ম‍্যায় ক‍্যা করুঁ? ইধার যাউঁ ইয়া উধার? আমি কোন পথে যে চলি…

একটা গোল দেখতে হাজার হাজার মাইল পথ হাঁটা যায়। আবার একটা হুক বা পুল দেখার পর মনে হয়, ‘ আহা, কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না! ‘

এ প্রসঙ্গে একটা আশ্চর্য ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। কপিলদেবের নেতৃত্বে একদিনের ক্রিকেটে ভারতের প্রথম বিশ্বজয়ের পর ভারতে সিরিজ খেলতে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতকে একেবারে দুরমুশ করে ফিরে গিয়েছিল।

একই ঘটনা ঘটেছিলো অস্ট্রেলিয়ায় ঝোড়ো ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ক্লাইভ লয়েড বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ফিরতি সিরিজে ঘরের মাঠে ইয়ান চ‍্যাপেল বাহিনীকে হোয়াইট ওয়াশ করেছিল ভিভ রিচার্ডস-সমৃদ্ধ লয়েড স্কোয়াড।

শোনা যায় হোম সিরিজে একটি ম‍্যাচে ব‍্যাট করছিলেন ভিভ। অস্ট্রেলিয়ায় তখন লিলি-টমো যুগ। সম্ভবত তাঁদেরই কোনো একজনের প্রচণ্ড গতির বলে ফ্রন্টফুটে ভীষণ জোরে ড্রাইভ করতে গিয়ে ফস্কান ভিভ। তারপর যেটুকু শক্তি সঞ্চিত ছিল তা দিয়েই বাঁদিকে নিজের মুখের পাশ দিয়ে বিদ‍্যুৎগতিতে বেরিয়ে যাওয়া ফস্কানো বলটিকে হুক করেন। মুহূর্তের মধ‍্যে আকাশপথে বল একেবারে গ‍্যালারিতে! চোখ বুজে এই রোমহর্ষক শটটি কল্পনা করুন। এই ছক্কা প্রায় অসম্ভব। এই রিফ্লেক্স কল্পনাতীত! প্রায় একশো পঞ্চাশ কিলোমিটার গতির একটা বলকে একই সঙ্গে একইসময়ে ফ্রন্টফুটে ড্রাইভ ও হুক করা ভিভ রিচার্ডসের পক্ষেই সম্ভব বোধহয়। এই বিরল শট দেখে গোটা গ‍্যালারি হতবাক হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধতার পরে গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে শুধু হাততালি আর হাততালি। এই শট দেখার পর বহ দর্শক স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে যান। কারণ এরপর দেখার আর কিছু বাকি থাকে না। এই শট দেখার জন‍্যই তো বেঁচে থাকা ও ক্রিকেট দেখা।

শেন ওয়ার্নের যে দুরন্ত ঘূর্ণি লেগস্পিনে মাইক গ‍্যাটিং বোল্ড হয়েছিলেন, যে বলটিকে শতাব্দীসেরা বল বলা হয়ে থাকে সেটি যাঁরা স্বচক্ষে দেখেছিলেন মাঠে বসে তাঁদের বাকি জীবনে আর কোনো ক্রিকেট ম‍্যাচ না দেখলেও চলবে।

তীক্ষ্ম ড্রিবলিং করতে করতে সাত-আটজনকে অতিক্রম ক’রে ইংল‍্যান্ডের বিরুদ্ধে যে নয়নাভিরাম গোল করেছিলেন দিয়েগো মারাদোনা সেটি গ‍্যালারিতে বসে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে তাঁরা ফুটবল খেলা দেখে সহজে আর আনন্দ পাবেন না। কারণ, ‘ এ পৃথিবী একবার পায় তারে…।’

ধ্রুপদী গোল, পিওর ক্লাসিকাল শট এইসব আছে বলেই ফুটবল ও ক্রিকেটের এমন তীব্র আকর্ষণ।

তাবলে একই দিনে একই সময়ে ইস্ট-মোহন ভারত-পাক ম‍্যাচ? একই দিনে প’ড়ে পাওয়া চোদ্দআনার মতো, মেঘ না চাইতেই জলের মতো প্রসাদবারী হ’য়ে ছা-পোষা বাঙালির তৃষিত অন্তরে ঝরে পড়ে এই দুই আশীর্বাদী ম‍্যাচ। আনন্দ আর উত্তেজনার পারদ চড়তে চড়তে ছড়িয়ে পড়ে সীমা থেকে অসীমে।
আহা, আজ রবিবারের এই মহার্ঘ‍্য সন্ধ্যার একটি মুহুর্তও কিন্তু কোনোভাবে মিস করা যাবে না।
টসে জিতলে ব‍্যাটিং না ফিল্ডিং?

আজ আগে গোল করবে কে? ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান?

আরও পড়ুন- জয়ের হ‍্যাটট্রিক মহামেডানের, ২-০ গোলে হারাল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সকে

 

Previous articleএশিয়া কাপে ভারত-পাক মহারণ, টি-২০ বিশ্বকাপের বদলা নিতে মরিয়া রাহুলরা
Next articleফিরহাদের সঙ্গে বৈঠক মোহনবাগান সচিবের