বাল্যবিবাহ রোধে নারী সেজে গ্রামে গ্রামে ঘোরেন হেডমাস্টারমশাই !

পায়ের ঘুঙুরে ওঠা শব্দছন্দে আর ছোট্ট স্টিলের পাত্রে আঙুলের টোকায় তাঁর গান শুনে থমকে দাঁড়ান পথচলতি মানুষও

মানুষকে সচেতন করা তাঁর নেশা।যদিও পড়ানো তাঁর পেশা।হুগলির খানাকুলে মাজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবাশিস মুখোপাধ্যায় সেই টানেই মাঝে মধ্যেই নারী সেজে বেরিয়ে পড়েন পথে পথে।গোলাপসুন্দরী সেজে তখন তিনি গান ধরেন।পাঁচালির সুরে ছোট ছোট পঙ্‌ক্তির ছড়ার মাধ্যমে গোলাপসুন্দরী গান ধরেন, ‘ছেলেদের ২১ আর মেয়েদের ১৮ হলে, তবেই তাদের দু’জনের বিয়ে দেওয়া চলে…।’

পায়ের ঘুঙুরে ওঠা শব্দছন্দে আর ছোট্ট স্টিলের পাত্রে আঙুলের টোকায় তাঁর গান শুনে থমকে দাঁড়ান পথচলতি মানুষও।আর সাজ ? পরনে জরির কাজ করা লাল র‌্যাপার। সুতির কুর্তিটাও লাল। গলায় নানা রঙের ছোট ছোট অনেক স্কার্ফ। ফর্সা গালে লাল রঙের টান। চোখে টানা কাজল। কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ। হাতে সোনালি রঙের চুড়।আপন মনে গাইতে থাকেন নিজেরই লেখা বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতার ছড়া-গান।

এইভাবে তিনি প্রচার শুরু করেছেন মাস সাতেক আগে। গোলাপসুন্দরী হয়ে কোথায় না কোথায় চলেছেন! শ্যাওড়াফুলি থেকে পায়ে হেঁটে তারকেশ্বরের শ্রাবণী মেলা। কৌশিকী অমাবস্যার ভিড়-ঠাসা তারাপীঠ। হেঁটে খানাকুল থেকে কলকাতা। গিয়েছেন বিধানসভাতেও। তাঁর লক্ষ্য একটাই, বাল্যবিবাহ বন্ধ হোক। আর সে কারণেই নারী সেজে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিজের গ্রাম, পাশের গ্রাম, ভিন‌্‌ জেলা, এমনকি ভিন্‌ রাজ্যেও।

কী বলছেন দেবাশিস? তাঁর কথায়, আমি চাই বাল্যবিবাহের মতো ব্যাধি সমাজ থেকে দূর হোক। চিকিৎসকেরাই তো বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনও মেয়ের যদি বাচ্চা হয়, তা হলে মা-বাচ্চা দু’জনেরই অপুষ্টিতে ভোগার সম্ভাবনা প্রবল। নানা ধরনের জটিল অসুখও দেখা দেয়। মূলত, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া সমাজের পরিবারে এই ব্যাধি বেশি। এ জন্য দায়ী মূলত অশিক্ষা। তাই মানুষকে শিক্ষিত হতে হবে। শুধু বাচ্চাদের পড়ালেই হবে না। বড়দেরও শিক্ষা দিতে হবে। আমি শিক্ষক হিসাবে সে কাজটাই করতে চাইছি।’’

কিন্তু এর মাঝেও তাঁর আক্ষেপ, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কমবয়সি মেয়েদের কেন বিয়ে দিতে নেই তা নিয়ে প্রচার করতে হচ্ছে, এটাই লজ্জার।

দেবাশিস থাকেন হুগলির আরামবাগের তিলকচক গ্রামে। স্কুল পাশের গ্রামেই। বছর বাইশ ধরে শিক্ষকতা করছেন। বছর দু-এক আগে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রথম বার বহুরূপী সেজেছিলেন। এলাকায় ডেঙ্গি সম্পর্কে সচেতন করতে সেবার গ্রামে ঘুরেছিলেন।

তাঁর কাছ থেকে জানা গেল যে তিনি কলকাতার একটি নাটকের দলে অভিনয় করতেন। সেই সময় বীরভূমের এক গ্রামে বহুরূপীদের সঙ্গে দেখা করতে যান থিয়েটারের কাজেই। তখন থেকেই মাথায় ছিল, নিজেও কখনও বহুরূপী সাজবেন। সেই কৌশল কে কাজে লাগিয়ে যে কোনও প্রচারের কাজ খুব সহজ হয়ে যায় বলে তিনি মনে করেন।বছরখানেক আগে নিজের এলাকার একটি বাল্যবিবাহের খবর নজরে আসে। তার পরেই তিনি ঠিক করেছিলেন, বহুরূপী সেজে মানুষকে এই ‘সামাজিক ব্যাধি’ সম্পর্কে সতর্ক করবেন।

প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগত। তবে মানুষের কাছে তাঁর সেজে ওঠা এতটাই আকর্ষণীয় হয়ে উঠল যে, একটু একটু করে ভরসা পেতে শুরু করেন দেবাশিস। নিজের কথাটা বলতে শুরু করেন। তার পর একটা সময় লিখতে শুরু করলেন ছড়া। তাতে প্রচলিত সুর বসালেন। পায়ে বাঁধলেন ঘুঙুর। নেচে, গেয়ে শরীরী ভঙ্গিমায় বাবা-মায়েদের বোঝাতে লাগলেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সন্তানদের বিয়ে দিতে হয়। তার আগে কোনও মতেই নয়। কারণ, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য একটা ন্যূনতম বয়সের প্রয়োজন হয়।

দেবাশিস তাই গাইছেন, ‘১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দেবে না, মা-বাবা হয়ে তাদের বিপদে ফেলবে না’, ‘অল্প বয়সে বিয়ে দিলে মেয়ে পড়বে রোগে, তোমাদেরই কষ্ট হবে মেয়ে যদি ভোগে’, ‘মেয়েদের ভাল করে লেখাপড়া শেখাও, লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের দেশ গঠনে লাগাও।’ এমন হাজারো পঙ‌্ক্তি লিখেছেন দেবাশিস।তিনি জানিয়েছেন  হুগলির বৈঁচি, তারকেশ্বর, চুঁচুড়া এবং বীরভূম জেলার লাভপুরের কাছে কয়েক জন কোনও রকমে টিকিয়ে রেখেছেন বহুরূপী শিল্পটিকে।তাই তিনি শিক্ষকতা এবং সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি বহুরূপী শিল্পকেও এভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চান।

জানলে অবাক হবেন যে তাঁর স্ত্রী কাবেরী মুখোপাধ্যায় প্রতি ছুটির দিনে তাঁকে নিজের হাতে সাজিয়ে দেন। স্বামীকে গোলাপসুন্দরীর রূপ দেওয়া কাবেরীর কথায়, ‘‘ও যে কাজটা করছে, তার উদ্দেশ্য অনেক মহৎ। আমাদের গ্রাম তো বটেই, আশপাশের অনেক গ্রামেই কমবয়সিদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ও সেটা আটকাতে চেয়েছে। যদি ওর প্রচারে কিছুটা কাজ হয়, তা হলে আমাদেরই মঙ্গল। আর সাজিয়ে দিই, কারণ, ও তো মেকআপ করতে পারে না। কখনও করেনি। ও সব পোশাকও পরেনি। আমিই তাই দায়িত্ব নিয়েছি।’’

বি টেক পাশ করেছেন দেবাশিস-কাবেরীর ছেলে দীপ্তম। মেয়ে দীপিকা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারের কাজে যান, সাহায্যও করেন। কিন্তু বাবার এই নারী সাজাটা খুব একটা পছন্দ করে না মেয়ে। কাবেরী বছর বারোর দীপিকাকে বুঝিয়েছেন, তার মতো কমবসয়িদের বিপদ থেকে বাঁচাতেই বাবা গোলাপসুন্দরী সাজেন।

এই পুরো বিষয়টি নজর এড়ায়নি পুলিশ প্রশাসনের। হুগলির জেলাশাসক পি দীপাপপ্রিয়া যেমন বলছেন, ‘‘দেবাশিসবাবুর এই গোলাপসুন্দরী হয়ে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচারকাজের কথা শুনেছি। বাল্যবিবাহ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে জেলা জুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়। র‌্যালিও হয়। আমরা সরকারি ওই সব অনুষ্ঠানে ওঁকে ডাকার কথা ভেবেছি। আসলে বাল্যবিবাহ রুখতে সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেবাশিসবাবু সেই কাজটা করছেন। প্রশংসনীয় কাজ। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে সাহায্য করায় উদ্যোগী হব।’’

 

 

 

Previous articleEntertainment: ঘোষণা হল ৬৭তম ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস, সেরা অভিনেতা রণবীর
Next article‘মার্চ ফর এডুকেশন’: কলকাতায় এলো SFI-এর সর্বভারতীয় জাঠা, ২ সেপ্টেম্বর কলেজস্ট্রিটে সমাবেশ