হে মোর দুর্ভাগা দেশ, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

কেন রে তুই জল ছুঁয়েছিস,
তুই না নীচুজাত?

তথাকথিত নীচুজাতের ছাত্র সবার জন‍্য রাখা জল ছুঁয়ে ফেলেছে! এবার কী হবে? তথাকথিত উঁচু জাতের জাত যাবে যে!

তাই শিক্ষক দিলেন কঠোর শাস্তির নিদান। লাগাও বেত,চালাও কিল, চড়, ঘুষি ঢালাও। মারের চোটে ছাত্র বেহুঁশ।

কী হলো তারপর? কী আবার! যা হয় তাই হলো। ছাত্রটির মৃত্যু হলো। এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলো কোথায়? জয়পুরে, ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। ‘

এগিয়ে চলেছে,’ একুশ শতকে চলে দেশ। ‘ কিন্তু জাতের নামে বজ্জাতি রয়েই গেলো। এখনো ‘সকল দেশের সেরা ‘ এই দেশের বহু জায়গায় জাত জালিয়াতির খেলা চলছে তো চলছেই। মহামানবদের বাণী ও কবিদের কবিতা এদেশে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। কেউ গ্রাহ‍্য করে না।
কবি তো সেই কবেই লিখে গেছেন :
হে মোর দুর্ভাগা দেশ,
যাদের করেছো অপমান,
অপমানে হতে হবে
তাহাদের সবার সমান!
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছো যারে
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে
তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে
তাহাদের সবার সমান।

কিন্তু কে শোনে কবির কথা? ধর্ম ও জাতপাত যেখানে মনুষ্যত্বের চেয়ে বড়ো হয়ে দেখা দেয় সেদেশে কে পরোয়া করে মানবিকতার? আসলে সবটাই হলো ‘ সিস্টেম ‘, ব‍্যবস্থা। কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জঘন্য এক সিস্টেম, যেখানে সংবিধানকে পদদলিত করা হয় প্রতিমুহূর্তে, কর্পোরেট শক্তির কাছে বিকিয়ে যাওয়া দেশের সরকার এই জনবিরোধী ব‍্যবস্থাকে যেন-তেন-প্রকারেণ টিকিয়ে রাখার অতন্দ্র চৌকিদার মাত্র।

মানুষের পরশেরে প্রতিদিন
ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছো তুমি
মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্ররোষে
দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে
সকলের সাথে অন্নপান।

এই সাবধানবাণী একদিন সত‍্য হবে এমন আশা করা যেতেই পারে। কিন্তু কবে?
দেশের স্বাধীনতা ৭৬ বছরে পদার্পণ করলো। ছিয়াত্তর বছর বড় কম সময় নয়। আর কবে এ দেশের মানুষ মানুষ হবে!

আসলে অনির্বচণীয় হুণ্ডি মুষ্টিমেয় লোকের হাতে। দেশের সব সম্পদ তাদের মুঠোয়। এমনকি দেশের সরকারও চলে তাদেরই ইশারায়। এখানে ধর্মের কল কীভাবে নড়ে যায় মিহিন বাতাসে, কী কী দেয়া-থোয়া হয়, কারা কাকে দেয় সব বলে গেছেন জীবনানন্দ কবি। মধ‍্যরাতে ফুটপাতে জেগে থাকা ভিখারীরা সব দেখেও কোথাও মুখ খোলে না প্রাণভয়ে।

ধনী আরও ধনী হয়, গরীব আরও গরীব। এ দেশে মনীষীদের বাণী, প্রেরণা, পরামর্শ ও উপদেশ সবই ব‍্যর্থ হয়েছে। অশিক্ষা, অজ্ঞতা, গোঁড়ামি আর অবিজ্ঞান এ দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায়।

নীচ, দরিদ্র, অন্ধ, মুচি ও মেথরদের যিনি ভাই ব’লে সম্বোধন করেছিলেন, তাদের রক্তের সঙ্গে নিজের রক্তের ফারাক যিনি দেখতে পান নি, তাঁর আন্তরিক আহ্বানেও কেউ সাড়া দেয় নি। জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভের স্বপ্নও পূরণ হয় নি আজও।

তোমার আসন হতে যেথায়
তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন
দিলে অবহেলে।
চরণে দলিত হয়ে ধুলায়
সে যায় বয়ে
সে নিম্নে নেমে এসো,
নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।

কবি অনর্গল লিখে চলেন। কেউ পড়ে না, কেউ শোনে না। মন্ত্রী, আমলা, সাংসদ, বিধায়ক কেউ পড়ে না, কেউ শোনে না কবির কথা। কেউ মানে না মনীষীদের অমূল্য বাণী। তারা শুধু দেখে কোথায় তাদের ব‍্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ হবে, কোথায় লাভ হবে তাদের এবং কীভাবে গোছানো যাবে আখের। তারা কর্পোরেটদের কথায়, ধনীদের কথায় ওঠাবসা করে। তাদের আজ্ঞা পালনেই তাদের জীবনের সার্থকতা। চুলোয় যাক দেশের দরিদ্র জনগণ, চুলোয় যাক দেশ।

যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে
সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি
গড়িছে সে ঘোর ব‍্যবধান।

কিন্তু, হা হতভাগ্য দেশ! বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মদিনে তাঁর আবক্ষমূর্তিতে মালা দিয়েই কর্তব্য শেষ আমাদের দেশনেতাদের। তাঁকে নিবিড় অধ‍্যয়ন ও তাঁর চর্চা থেকে দরিদ্র দেশবাসীকে যতটা সম্ভব দূরে রাখাই দেশনেতাদের অন‍্যতম জরুরি দায়!

দেশবাসীকে অশিক্ষিত ক’রে রাখো! একতাবদ্ধ হতে দিও না। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসাহিত করো। জাতপাত ও ধর্ম-আফিম খাইয়ে অন্ধকারে ঠেলে দাও যুবসমাজকে। বিজ্ঞানের বিরোধীতা করো। কেউ যেন কোনো প্রশ্ন তুলতে সাহস না পায়। রাজার হস্ত যেন বিনা বাধায় সমস্ত কাঙালের ধন চুরি করতে পারে তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করো।

দেশবাসীর দারিদ্র ও অশিক্ষা আমাদের দেশনেতাদের সবচেয়ে বড়ো পুঁজি। তাই গরীবের পাশে কেউ নেই। ওদের জন‍্য কিছুই নেই। আর সেই কারণেই কবির আক্ষেপ ও দীর্ঘশ্বাস কাব‍্যগ্রন্থের ধূসর পাতায় মুখ লুকিয়ে কাঁদে শতবর্ষের নিঃসঙ্গতায় :

তোমার চরণ যেথায় নামে
অপমানের তলে
সেথায় আমার প্রণাম
নামে না যে
সবার পিছে, সবার নীচে,
সব-হারাদের মাঝে ।

আরও পড়ুন- স্বপ্ন বিক্রি করতে আসিনি, সভাপতি পদে এসে জানিয়ে দিলেন কল‍্যাণ চৌবে

Previous articleস্বপ্ন বিক্রি করতে আসিনি, সভাপতি পদে এসে জানিয়ে দিলেন কল‍্যাণ চৌবে
Next articleমরশুমের প্রথম জয় ইমামি ইস্টবেঙ্গলের, ডুরান্ড কাপের শেষ ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-কে ৪-৩ গোলে হারাল তারা