স্বপ্ন প্রেমিকা নীরা, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ বাসস্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ ।। ‘

নীরা আর নারী বেশ কাছাকাছি দুটো শব্দ। আ-কার আর ঈ-কার শব্দ দুটোকে আলাদা ক’রে রেখেছে। কাব‍্যরসিকেরা বলেন, চাইলেই ছোঁয়া যায় অথচ সারাটা জীবন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় নীরা। থাকে স্বপ্নে আর অবচেতনে। মূর্ত হয়ে ওঠে শুধু কবিতায়। নারীও তো প্রায় তাই-ই। যেমন মোনালিসা মূর্ত ছবিতে। লিয়োনার্দোর মোনালিসা আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরা। এইসব নিয়ে কতকাল ধরে কত যে জল্পনা আর চায়ের কাপে তুফান!

‘ হিরন্ময়, তুমি নীরার মুখোমুখি দাঁড়িও না,
আমি পছন্দ করি না
পাশে দাঁড়িও না,
আমি পছন্দ করি না… ‘

সুনীল তাঁর ‘ হঠাৎ নীরার জন‍্য ‘ কাব‍্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন
‘ নীরাকে এবং নীরাকে ‘।

বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন পূর্ণেন্দু পত্রী। ১৯৭৮ সালে প্রথম সংস্করণ প্রকাশ হতেই খুব হইচই ফেলেছিল বইটি। তৎকালীন যুবসমাজ তো বটেই, এমনকি প্রবীণ পাঠকেরাও বইটি সংগ্রহ করতেন যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গেই।
তবু আজ এতকাল পরেও নীরারহস‍্যের কোনো কিনারা হয় নি। কবিকে বারবার প্রশ্ন করেও নীরার আসল পরিচয় জানা যায় নি। চিরযৌবনা,
চিরঅবগুণ্ঠনবতী,কবির
স্বপনচারিনী নীরা তাই আজও পাঠকের আগ্রহের বিষয়।

‘ দাঁড়িয়ে রয়েছো তুমি বারান্দায়
অহঙ্কার তোমাকে মানায় না,
তুমি কি যে-কোনো নারী
যে-কোনো বারান্দা থেকে
সন্ধ্যার শিয়রে
মাথা রেখে আছো? ‘

আশির দশকের কিছু আর্জি, কিছু অনুরোধ যেন আজও ভেসে বেড়ায় কবিতার বিশুদ্ধ বাতাসে।
সুনীল দা, কে আপনার নীরা?
প্লিজ বলুন না দাদা, নীরা কোথায় থাকে?
ওহে কবি, তোমার গুণমুগ্ধ পাঠকবৃন্দ, বিশেষ ক’রে পাঠিকারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন নীরার আসল রূপ একদিন প্রকাশিত হবেই এই আশায়।
সুনীল, তুমিও কবি, আমিও, তুমি কি আমাকেও বলবে না কে তোমার নীরা?
এইসব প্রশ্নের উত্তরে মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অথবা হিরন্ময় নীরবতায় নিরুত্তর থাকা কবি আরও রহস‍্যময়ী করে তোলেন তাঁর নীরাকে।

‘ নীরা নাম্নী মেয়েটি কি
শুধু নারী?
মন বিঁধে থাকে
নীরার সারল‍্য কিংবা লঘু-খুশী,
আঙ্গুলের হঠাৎ লাবন‍্য কিংবা
ভোর ভোর মুখ

আমি দেখি, দেখে দেখে
দৃষ্টিভ্রম হয়
এত চেনা, এত কাছে,
তবু কেন এতটা সুদূর… ‘

‘… তোমার হাসিতে যেন
ইতালির এক শতাব্দীর ছায়া ‘

পাঠকদের অনেকেরই আবার খুব পছন্দ কবির কল্পিত নীরাময় জীবন। থাক না আড়াল, থাক না ঢাকা। থাক বিমূর্ত। দেখে ফেললে, জেনে ফেললেই তো সব আগ্রহের অবসান। থাক না নীরা অনন্ত মাধুরী নিয়ে অধরা।
কিন্তু চিরঅস্থির কবি নিজেই মাঝেমাঝে ‘ চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’-র বেড়া ভেঙে তাঁর স্বপ্নের রহস‍্যমানবীকে নামিয়ে আনেন ধুলোবালি মাখা মর্ত‍্যভূমে, বিশেষ দিনে বিশেষ লগ্নে। সে কি সচেতনে নাকি অবচেতনে?

আরও পড়ুন- ইস্ট-মোহন ভারত-পাক, উৎপল সিনহার কলম

‘… নীরা, তোমায় দেখি আমি
সারাবছর মাত্র দু’দিন
দোল ও সরস্বতী পুজোয় —
দুটোই খুব রঙের মধ্যে
রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে
সারাবছর মাত্র দু’দিন —
ও দুটো দিন তুমি আলাদা,
ও দুটো দিন তুমি যেমন
অন‍্য নীরা
বাকি তিনশো তেষট্টিবার
তোমায় ঘিরে থাকে অন‍্য
প্রহরীরা… ‘

এইভাবে চলতে চলতে
‘ নীরা, তোমার কাছে ‘ কবিতার শেষে কবি বলছেন,
‘… আমি তোমায় লোভ করি নি, আমি তোমায় টান মারি নি
সুতোয়
আমি তোমার মন্দিরের মতো
শরীরে ঢুকি নি ছলছুতোয়
রক্তমাখা হাতে তোমায়
অবলীলায় নাশ করি নি ;
দোল ও সরস্বতী পুজোয়
তোমার সঙ্গে দেখা আমার —
সিঁড়ির কাছে আজকে এমন
দাঁড়িয়ে রইলে
নীরা, তোমার কাছে আমি নীরার জন্য রয়ে গেলাম
চিরঋণী।। ‘

তাহলে কি শেষ পর্যন্ত দেখা গেল নীরাকে? দেখা দিল নীরা? বাকি তিনশো তেষট্টি দিন কারা ঘিরে থাকে নীরাকে ? অন‍্য প্রহরীদের মতো কবিও কি নীরার একজন প্রহরী মাত্র?
ওহ্, মাঝেমাঝে যেন দমবন্ধ হয়ে আসে প্রেমিক পাঠকের। যেভাবেই হোক নীরাকে চাই।
আর কতকাল নিরবয়ব হয়ে থাকবে নীরা? ভালো লাগে না এই নীরাহীন নিরালা জীবন।

আবার ফেরা যাক কবির কাতর হৃদয়ের ব‍্যাকুলতায়, যেখানে সারাটা জীবন কবি অবোধ শিশুর মতো নীরার
প্রশ্রয়ভিখারী। কবি চান বাল‍্য প্রেমিকার স্নেহ। নীরার দেওয়া যে কোনো শাস্তি অসহ‍্য কবির কাছে। চিরউদার কবি শুধুমাত্র নীরার জন‍্যই সার্বজনীনতাকে শত্রু ভাবেন।

আরও পড়ুন- অভিমান-তিক্ততা এখন অতীত, ফুটবল মিলিয়ে দিল তৃণমূলের জাভেদ-সুশান্তকে

অতৃপ্তির পাত্র হাতে বারবার ফিরে আসেন নীরার চোখের কাছে। সেই নীরা, যে দরজা খুললে জন্তু থেকে মানুষ হয়ে ওঠেন কবি। কবির বয়স থমকে থেমে থাকে নীরার কাছে গেলে। যা উচ্চারণ করলে মিথ্যা থেকে দূরে থাকা যায়, যা স্পর্শ করলে পাপ থেকে দূরে থাকা যায় সেই স্পর্শমণি নীরা।

‘ ঠোঁট দেখলেই বুঝতে পারি
তুমি এদেশে বেড়াতে এসেছো
ঐ গ্রীবা, ঐ ভুরুর শোভা
এদেশী নয় —
কপালে ঐ চূর্ণ অলক,
নিমেষহারা দৃষ্টিপলক
ঐ মুখ, ঐ মুখের রেখা
এদেশী নয়! ‘

এই দেখো আবার বিভ্রান্তি, আবার রহস্য! নীরার বাড়ি কোথায়? এই বাংলায় নয়?
এই ভারতবর্ষে নয়? এই পৃথিবীতেও নয়? তাহলে কোথায়? নীরা কি কোনো ভিনগ্রহের বাসিন্দা?

‘ বিদেশ ‘ কবিতার উপসংহারে কবি স্বয়ং কী লিখছেন দেখা যাক :
‘… এই পৃথিবী বিদেশ তোমার
কত দিনের জন‍্য এলে?
বেড়াতে আসা, তাই কি মুখ
অমন সুখ-ছোঁয়া!
যদি তোমায় বন্দী করি
মুঠোর মধ‍্যে ভ্রমর ধরি
দেবতা-রোষে হব ভস্ম-ধোঁয়া? ‘
চিরসন্দিহান, চিরসংশয়ীদের
‘আছে’ আর ‘নেই’-এর মাঝখানে থেকে যাওয়া নীরার বসবাস কি যে কোনো প্রেমিকের হৃদয়ের অতলে? তাও হতে পারে। তবে একটা ব‍্যাপারে বোধহয় অনেকেই একমত হবেন যে নীরার নিরালায় থাকাই ভালো।

Previous articleBreakfast Sports: ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস
Next articleঐতিহাসিক চা -বাগান কর্মী সম্মেলন , আজ অভিষেকের সমাবেশ