‘মহালয়ার অলৌকিক ভোর’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

অন্ধকার থাকতেই বাবা সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন। মা উনুন জ্বালিয়ে চায়ের জোগাড় করতেন। ঘুম জড়ানো চোখে ভাইবোনেরা মিলে শোনা হতো বাজলো আলোর বেণু মাতলো রে ভুবন।

বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজ কুমার মল্লিক। বাঙালি জীবনের তিন অবিস্মরণীয় নাম। ত্রয়ীর অমর সৃষ্টি মহিষাসুরমর্দিনী। অনবদ‍্য লেখা, জাদুকরী ভাষ‍্যপাঠ, দীর্ঘজীবী সুর। ফি-বছর শোনা শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠ কিন্তু কখনও পুরোনো হয় না, হবেও না। চিরনতুন। শৈশব-যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে যাঁদের বার্ধ‍ক‍্যে উপনীত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁরা জানেন মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনীর মাহাত্ম্য। কৈশোরের ঘোর লাগা সেই অলৌকিক ভোর জীবনের পর্বে পর্বে নতুন অনুভূতি ও উপলব্ধির সন্ধান দিতে দিতে যেন পরম যত্নে হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকে মহাপ্রস্থানের পথে।

‘ তব অচিন্ত‍্য ‘ শুনতে শুনতে বারবার ঘুমিয়ে পড়া যে ছোট্ট কিশোরকে বাবা গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুম ভাঙাতেন সেই বাবা আজ কোথায়? চায়ের জোগাড়ে ব‍্যস্ত সেই মা কোথায় আজ? কোন্ তেপান্তরে? পিতৃমাতৃহীন সেই বালক আজ নিজেই হয়তো একজন দায়িত্বশীল বাবা। আজ তার অনেক কাজ। পিতৃতর্পনে এক্ষুনি তাকে যেতে হবে গঙ্গায়।

বাবা থাকতে তার ঘুম ভাঙতো না। আজ বাবা নেই, ঘুমও ছুটেছে তার। আলপ্রাজোলাম হার মেনেছে নিদ্রাহীনতার কাছে। আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী ব‍্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ার ফাঁকেফাঁকেই বারবার ঘুম ভাঙতে থাকে তার। জাগরণে যায় বিভাবরী।

দীর্ঘ জীবন। কত দুঃখতাপ। কিন্তু শরতকাল, শুভ্রসুন্দর কাশফুল, শিউলির মনমাতানো গন্ধ আর মহালয়ার আশ্চর্য ভোর কেমন যেন বেদনামেশা এক আনন্দ বয়ে আনে। যেন টাইম মেশিনে চড়িয়ে হারানো শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের উচ্ছাসমাখা হিরন্ময় দিনগুলি অন্তত একটা দিনের জন‍্য ফিরিয়ে দেয় মহার্ঘ‍্য মহালয়া।

যদিও মহালয়া অর্থাৎ ‘ মহৎ বা মহান আলয় ‘ প্রকৃতঅর্থে কোনো আনন্দের দিন নয়। দিনটি পিতৃপুরুষদের তর্পন করার দিন। তর্পনশেষে পিতৃপক্ষের অবসান এবং দেবীপক্ষের সূচনা। কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনীর রেডিও সম্প্রচার এই বিশেষ দিনটির সাথে জুড়ে যাওয়ায় বাঙালির কাছে এই দিনটির তাৎপর্য অসীম।

যে সংস্কৃত স্তোত্রের মানে না বুঝে শুধু সুরের ভাষায় কিছু একটা পবিত্র বার্তা বুকের গভীরে পৌঁছে যেত ঘুমজড়ানো আলোআঁধারি সেই ভোরে, আজ নিদ্রাহীন মন সেই স্তোত্রের প্রতিটি শব্দ কান পেতে শোনে। কী আশ্চর্য জীবনের যাত্রাপথ!

‘ ইয়া চণ্ডী মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনী… ‘, আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর… ‘।
মেঘমুক্ত আকাশ। বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। কী এক অচেনা পরশে, অজানা হরষে মন ছুটে বেড়াতে থাকে দিক থেকে দিগন্তরে। এক অব‍্যক্ত ও অনির্বচণীয় আনন্দে ভরে ওঠে মন। এই আশ্চর্য লগ্নে সবাই কেমন যেন উদার হয়ে ওঠে। এক মনের খবর জানতে উদগ্রীব হয় অন্য মন। অন‍্যের বিপন্নতায় পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। মন হঠাৎই বড়ো হয়ে ওঠে। আকাশের মতো প্রশস্ত, প্রসারিত। এই সময়ে বিমর্ষতা যেন বেমানান। যেন কোনো জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বিশ্বপ্রকৃতির সর্বস্তরেই ছড়িয়ে পড়ে এক অপার্থিব আলো। দিকে দিকে বেজে ওঠে আগমনীর অনন‍্য সুর। জেগে ওঠে প্রাণ। সবাই যেন স্বেচ্ছায় আনন্দের বার্তাবাহক হতে চায়। মা আসছেন মা আসছেন এই আনন্দবার্তা ছড়িয়ে পড়ে হাটে মাঠে গ্রামে শহরে, প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি অন্তরে। শরতের আকাশের মতোই মেঘমুক্ত হতে চায় বাঙালি মন। হাত বাড়িয়ে দিতে চায় অন‍্য হাতের দিকে।

আসন্ন শারদোৎসবের অনাবিল আনন্দসম্মেলনের প্রাক্কালে জীবনের নানান চাপে দমে থাকা মন শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে ওঠে। চার দেওয়ালের নিয়মমাফিক সীমাবদ্ধতার অভ‍্যাস ভেঙে বেরিয়ে পড়তে চায় মন, আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে চায়। বুকের মাঝে সাড়া পেতে চায় বিশ্বলোকের। সবার সুরে সুর মিলিয়ে বিশ্বজননীর মধুময় বন্দনাগান গাইতে চায়।

বোধনের ঢাক বাজতে শুরু করে অন্তরে। এই বিরল সুখানুভূতি দিতে পারে কেবলমাত্র শরতকাল। শরৎ জানে মায়ের মন্ত্র, শরৎ বোঝে মায়ের মন। সারা বছরের হাজার কর্কশতার মাঝে বিরলের মধ‍্যে বিরলতর এই কয়েকটি দিন যেন ‘ কী মায়া দেয় বুলায়ে ‘।

এই বহুআকাঙ্খিত বিরলতর দিনগুলির দিনগোনা শুরু হয় যে অলৌকিক ভোরে, সেখানেই চিরঞ্জীব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, বাণীকুমার ও পঙ্কজ মল্লিক। সেখানেই বারবার ফিরে আসেন হারিয়ে যাওয়া বাবা-মা, দূরে চলে যাওয়া ভাইবোনেরা। আধো আলো আধো অন্ধকারে, আধো ঘুমে আধো জাগরণে তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোরলাগা সেই মহালগনে বিষাদ আর আনন্দ পরস্পরের চোখে চোখ রাখে। হাতে রাখে হাত। মায়া জড়ানো অমর কণ্ঠে মানবেন্দ্র মুখোপাধ‍্যায় গাইতে থাকেন :
তব অচিন্ত‍্য রূপ-চরিত-মহিমা,
নব শোভা, নব ধ‍্যান
রূপায়িত প্রতিমা
বিকশিত জ‍্যোতি
প্রীতি মঙ্গল বরণে।

আরও পড়ুন- সরকারের গোপন প্রতিবেদন; বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশনা মানা হয়নি অনেক মণ্ডপে

Previous articleভারতীয় সিনেমায় রেকর্ড, একদিনে সিনেমা দেখলেন ৬৫ লক্ষ মানুষ
Next articleBreakfast Sports : ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস