আজ মহা সপ্তমী, উৎপল সিনহার কলম

ষষ্ঠীতে খাই যষ্টিমধু
গাইতেই হয় মণ্ডপে
গলাই যদি ঠিক না থাকে
তাহলে সব পণ্ড যে!

সপ্তমীতে রপ্ত করি
তপ্ত লুচির সহ‍্যগুণ
যদিও আমার দারুণ প্রিয়
একমুঠো ভাত একটু নুন।

অষ্টমীতে কষ্ট ক’রে
কেষ্ট আনার কী দরকার?
একই মঞ্চে দুর্গা ও শিব
এই বা কী কম চমৎকার!

তারপরেই তো সেই নবমী
হর্ষ ক্রমেই বিষাদময়
মেয়েকে আর শ্বশুরবাড়ি
না পাঠালে কেমন হয়?

সেটা আবার হয় নাকি গো
বরটা কি খুব খারাপ লোক?
ডিভোর্স ফাইল করার আগে
এই ব‍্যাপারে চর্চা হোক।

শারদোৎসব। বাঙালির প্রাণের উৎসব। শ্রেষ্ঠ উৎসব। আজকাল ধর্মীয় ব‍্যাপারটার চেয়েও মুখ‍্য হয়ে উঠেছে পুজোর আনন্দ ও মহা সম্মেলন। সবার সঙ্গে সবার দেখা। যে যেখানেই থাকুক পুজোর চারটে দিন নির্ভেজাল ছুটি। অপূর্ব অবকাশ। এমন আনন্দের হাট বছরে মাত্র একবারই বসে।

অনেকের কাছেই পুজোর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পুজোর হাজার অনুষঙ্গ। প‍্যান্ডেল, ডেকরেশন, আলোকসজ্জা, প্রতিমা নির্মান , ঢাক ও কাঁসর, পুজো ঘিরে খাবার-দাবার ও অন‍্যান‍্য দ্রব‍্যের বিভিন্ন স্টল, শাড়ি কাপড় ও জুতোর ব‍্যবসা, ছোট বড় মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি থেকে সারা বছরের রোজগারের একটা বিরাট অংশ যুক্ত থাকে বহু মানুষের। কয়েকটি দিনের এই আনন্দ সম্মেলনের আশায় হা-পিত‍্যেশ ক’রে বসে থাকেন বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ। শারদোৎসবের অন‍্যতম সার্থকতাও জুড়ে থাকে এখানে।

মহালয়ার পরদিন থেকেই প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী , পঞ্চমী এইভাবে দিন গোনা হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী, এই দিনগুলির প্রত‍্যেকটিরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য আছে।
শুভ মহাষষ্ঠীতে দেবীবোধন দিয়ে শারদোৎসবের সূচনা হয়। উদ্বোধনের এই দিনটিতে সকলে বিশ্বমাতার চরণতলে সমবেত হন। কথিত আছে ওইদিন দেবী কৈলাসের যাত্রা শেষ করে মর্ত‍্যে আগমন করেন। ষষ্ঠী হলো কোনো চান্দ্র মাসের ষষ্ঠ দিন। যদিও ষষ্ঠী প্রতি মাসেই একবার আসে, কিন্তু মহাষষ্ঠী নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

আর, মহা সপ্তমীতে মহাপূজা হয়। সূর্য ওঠার আগেই একটি কলাগাছকে পবিত্র গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে তারপর এটিকে নববধূর ( কলা বউ ) মতো শাড়ি পরানো হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে বিশ্বাস করা হয় যে মা দুর্গা মহা অষ্টমীতে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন।

ওই দিন ভক্তেরা পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে দেবীকে আরাধনা করেন। নয় বছরের কম বয়সী মেয়েরা এদিন দেবী দুর্গা রূপে পূজিত হন। এই আচারটি কুমারী পূজা নামে অভিহিত হয়। মহাষ্টমীর সন্ধ্যায় ১০৮ টি
প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধিপূজা করা হয়। কথিত আছে দুর্ধর্ষ মহিষাসুর বধের সময় সন্ধির এই ক্ষণেই দেবী দুর্গা চামুণ্ডা বা কালীমূর্তির রূপ ধারণ করেছিলেন। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথির শুরুর ২৪ মিনিট, অর্থাৎ মোট ৪৮ মিনিটের মধ‍্যে শেষ করতে হয় সন্ধিপূজা।

নবমীর সন্ধিপূজা সমাপ্তির অর্থ দুর্গাপূজারও প্রায় সমাপ্তি।

পুজো নিয়ে সম্বৎসরের এত আয়োজন, এত তোড়জোড় সবই শেষের পথে নবমী নিশীথে। তাই নবমীতে বাঙালির মন ভারাক্রান্ত হয়। বিষন্ন মনে সকলেই গাইতে থাকেন, যেও না নবমী নিশি…
ওই দিনে পূজা করা হয় দেবীর সিদ্ধিদাত্রী রূপের। এই দেবীর উপাসনায় সংসারে সুখ ও সমৃদ্ধি আসে।
তারপরই বিজয়া দশমী। যার সঙ্গে যুক্ত শুভ শক্তির বিজয়ের উপাখ‍্যান। অশুভ শক্তির বিনাশ।
আশ্বিনের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে পিতৃগৃহ ছেড়ে কৈলাসে পতিগৃহে পাড়ি দেন দেবী। এই দিনটিতে মায়ের প্রতীকী বিসর্জন বা নিরঞ্জন হয়। নিরঞ্জনের শেষে সকলে সকলকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আলিঙ্গন করেন। ছোটরা বড়দের প্রণাম করে। বড়রাও ছোটদের আশীর্বাদ করেন। সকলে সকলকে মিষ্টিমুখ করান।

দুর্গাপূজার বহুমুখী তাৎপর্য রয়েছে। সত‍্য ও ধর্মের জয় এবং মিথ্যা ও অধর্মের বিনাশ যার অন‍্যতম। অশান্তির ভয়াবহ অন্ধকার দূর করে বিশ্বে কাঙ্খিত শান্তির আলো ছড়িয়ে দেওয়াও এই পূজার অন‍্যতম উদ্দেশ্য। সমস্ত বৈষম্য ও ভেদাভেদের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বমানবতার প্রতিষ্ঠাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গাপূজা শুধুমাত্র ধর্মীয় কৃত‍্য নয়, তা সর্বজনীন উৎসব। সমস্ত বিচ্ছিন্নতার উৎসকে নির্মূল করে মহাঐক‍্য প্রতিষ্ঠাও এই মহাপূজার গূঢ় উদ্দেশ্য। দুর্গাপূজাকে বলা হয় সম্মিলিত দেবশক্তির পূজা।

সবশেষে, ‘ আসছে বছর আবার হবে ‘-র সমবেত হৃদয়ের কোরাস থেকে যে আশা ও আশ্বাস উচ্চারিত হয় বিজয়া দশমীর মহালগ্নে, তারই সঙ্গে ধ্বনিত হয় শান্তি ও কল‍্যানের যুগ্ম বার্তা।
দশমী তিথিতে পূজার এক পর্যায়ে উচ্চারিত হয় এই হার্দিক মন্ত্র :
‘ ওঁ গচ্ছ গচ্ছ পরং স্থানং
য দেবো মহেশ্বরঃ
সংবৎসবব‍্যতীতে তু
পুণরাগমনায় চ ‘।

আরও পড়ুন- ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’-এর হাত ধরে জমজমাট উদ্বোধন গিরীশ পার্ক ‘তরুণ সঙ্ঘের’

Previous articleভয়াবহ দুর্ঘটনা, কানপুরে পুকুরে ট্র্যাক্টর উল্টে মৃ*ত ২৫ তীর্থযাত্রী
Next articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ