‘ভেঙে যাক মোহ’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ মিছিলেও প্রেম হোক,
ভেঙে যাক মোহ
তুমি সাজো ব‍্যারিকেড,
আমি বিদ্রোহ। ‘

মিছিল হোক বহুমাত্রিক। সমস্ত দরজা খুলে যাক। প্রচলিত প্রথার হাত ছাড়ুক মিছিল। যান্ত্রিকতা মুক্ত হোক। অন্ধজনে আলো আর মৃতজনে প্রাণ দিতে দিতে এগোক মিছিল। সংস্কারের দাসত্ব ভুলে ছকভাঙা অপূর্ব সৃজনছন্দে মেতে উঠুক মানববন্ধন। শুধু ঘুম ভাঙার গান গেয়েই দায়মোচন নয়,
‘ সবাই এসেছে তুমি আসোনিতো ‘ বলার দিন যেন শেষ হয় মিছিলের। জীবনের প্রতিটি পর্ব ও স্তর যেন জড়িয়ে থাকে মিছিলের ছত্রে ছত্রে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

‘ এখন যৌবন যার
মিছিলে যাবার তার
শ্রেষ্ঠ সময়,
এখন যৌবন যার
যুদ্ধে যাবার তার
শ্রেষ্ঠ সময়। ‘
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়।
সেখানে সংসার থাকে,
সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে
সাজাতে সংসার
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা
জ্বালাতে সংসার। ‘
( কবিতা : নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়
কবি : হেলাল হাফিজ )

‘… আর না হ’লে যত্ন করে
ভুলেই যেও, আপত্তি নেই।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে,
কার কি তাতে ?
আমি না হয় ভালোবেসেই
ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা
খুন করেছি, কী আসে যায়?

এক জীবনে কতোটা আর
নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর
কষ্ট দেবে? ‘
( কবিতা : প্রস্থান )

শুধু ব‍্যারিকেড, বিদ্রোহ আর মিছিল নয়, নিজের ভুলগুলো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার অকপট প্রবণতাই নয়, হেলাল হাফিজ অনায়াসেই তাঁর কবিতার শিরোনামে লিখতে পারেন :
বেদনাকে বলেছি কেঁদো না।
যেখানে সযত্নে লেখেন,
‘ দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয় যে, আমাকে দুঃখ দেবে। ‘

বর্ণময় এই কবির স্বাতন্ত্র নিয়ে কথা বলার আগে তাঁর আরও একটি লেখায় চোখ রাখা যাক :
‘ ব‍্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের
এতো আয়োজন,
আগামী মিছিলে এসো
স্লোগানে স্লোগানে হবে
কথোপকথন।
আকালের এই কালে
সাধ হলে পথে ভালোবেসো,
ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে
আসো যদি
লাল শাড়িটা তোমার
পরে এসো। ‘
( কবিতা : ঘরোয়া রাজনীতি )

প্রেম ও বিপ্লব হাতে হাত রেখে পরম নিশ্চিন্তে হাঁটে হেলাল হাফিজের কলমে। বাংলা একাডেমি-সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত এই কবির জন্ম ১৯৪৮ সালে, বাংলাদেশে। তাঁর প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ, ‘ যে জলে
আগুন জ্বলে ‘।

‘ জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুণ তাপস
এই নে চারু শীতল কলস। ‘
( কবিতা : যাতায়াত )
‘ অশ্লীল সভ‍্যতা ‘ কবিতাটি পড়লে দেখা পাওয়া যায় বিশ্বমানবতার একনিষ্ঠ পূজারীর :
‘ নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না! ‘

তাঁর ‘ অচল প্রেমের পদ‍্য’-র চতুর্থ কবিতায় ধরা দেন নরম গরম অভিমানজর্জর প্রেমিক :
‘ ভালবেসেই নাম দিয়েছি
‘ তনা ‘
মন না দিলে
ছোবল দিও তুলে
বিষের ফণা। ‘

গলি থেকে রাজপথ, মিছিল থেকে হাসপাতাল, নির্জনতা থেকে জনকল্লোল, প্রেমোচ্ছাস ছুঁয়ে বিষাদসিন্ধু, নেত্রকোনা থেকে সারা বিশ্বের আনাচেকানাচে কলম হাতে কবি হেলালের বৈচিত্র্যময়
কাব‍্যপরিক্রমা কবিতা পাঠকদের অন্যতম আকর্ষণ।
নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের বেদনা রীতিমতো উপভোগ করেন এই আশ্চর্য কবি। আর সেখান থেকেও প্রয়োজনমতো আহরণ করেন কবিতার সুর ও আলো। সুর আলো ছড়ায় আর আলো সুর । আসুন, আলো ও সুরের খেলা দেখি আরেকবার।
‘ বড্ড জানান দিতে
ইচ্ছে করে, — আছি,
মনে ও মগজে
গুনগুন করে
প্রণয়ের মৌমাছি। ‘

প্রেম ও দ্রোহ আছেই, সঙ্গে
অনন্ত আত্মজিজ্ঞাসার তাড়না
কবিকে স্থিতপ্রজ্ঞার সন্ধান দেয় বারংবার।

‘ বোকা উদ্ভিদ তবে কি
মানুষের কাছে প্রেম চেয়েছিল?
চেয়েছিল আরো কিছু বেশি ‘।
ব‍্যক্তিগত সুখ নয়, সামষ্টিক
মুক্তিকামিতাই পরম কাম‍্য। নারীপ্রেমের চেয়ে বড়ো দেশপ্রেম। স্বাধীনপাখি অকপটে লেখেন :
‘ আমি কোনো পোষা
পাখি নাকি?
যেভাবে শেখাবে বুলি
সেভাবেই ঠোঁট নেড়ে যাবো,
অথবা প্রত‍্যহ
মনোরঞ্জনের গান ব‍্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায় অনুকূলে
খেলাবো আকাশ,
আমি কোনো সেরকম
পোষা পাখি নাকি? ‘
( রাখাল )

মনন ও হৃদয়ের দাবি সমান গুরুত্বে উদ্ভাসিত কবি হেলালের সৃজনবার্তায়। কবি একইসঙ্গে আত্মপ্রত‍্যয়ী ও সমর্পিত। কোনো নির্দিষ্ট তত্ত্ব বা সময়ের গণ্ডিতে বেঁধে রাখা অসম্ভব এই অকপট কবিকে।

‘ আমি আর কতটুকু পারি?
কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে
দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু
তোমাকে মানায়।
ওইটুকু নিয়ে তুমি বড়ো হও,
বড়ো হতে হতে কিছু নত হও,
নত হতে হতে হবে
পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে,
পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ,
আমি আর কতোটুকু পারি?
এর বেশি পারে নি মানুষ।
( পৃথক পাহাড় )

সভ‍্যতার সমস্ত অনিয়ম ও সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে আজীবন সোচ্চার হেলাল হাফিজ তাঁর
‘ রাখালের বাঁশি ‘ কবিতার শুরুতেই রেখেছেন এই
অভাবনীয় আবেদন :

‘ কে আছেন ?
দয়া করে আকাশকে
একটু বলেন —
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না। ‘

আরও পড়ুন- Haldia: সুতাহাটা পল্লীশ্রী সমবায় সমিতির নির্বাচনে বিরোধী শূন্য তৃণমূল!

Previous articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ
Next articleBreakfast Sports: ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস