খায়রুল আলম, ঢাকা: যে বাড়িতে বসে লিখেছেন প্রথম কবিতা, কবিতার বই, যে বাড়ির উঠোনজুড়ে কেটেছে সোনালী শৈশব- কৈশোর, সম্প্রতি বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের(Taslima Nasrin) স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ি ভেঙে ফেলা হলো। ‘অবকাশ’(Abokash) নামের বাড়িটি ভেঙে ওই স্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। টাঙানো হয়েছে ডেভেলপার কোম্পানির বিশাল আকারের বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ড।
বাড়ি ভেঙে বহুতল বানানোর বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন তসলিমার ভাইপো সাফায়েত কবীর। তিনি বলেন, এই বাড়ি ছিল দাদা প্রয়াত ডা. রজব আলীর। তিনি মারা যাওয়ার পর সম্প্রতি এই বাড়ির জমি তার উত্তরাধিকারের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। এর মধ্যে সামনের অংশে তার বাবা ও কাকার জায়গা। আর পেছনে রয়েছে পিসিদের জায়গা।
জানা গেছে, সম্প্রতি ময়মনসিংহের কবি শামীম আশরাফ ওই বাড়ির একটি ভিডিও পোস্ট করে তাতে লেখেন, তসলিমা নাসরিনের শৈশব-কৈশোর কেটেছে যেখানে। নান্দনিক ‘অবকাশ’ বাড়িটা ভেঙে উঁচু হয়ে উঠছে। এভাবেই শহরের কত কত নান্দনিক বাড়ি স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। এই পোস্টটি নজরে আসে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। ভিডিওটি স্মৃতিচারণ করেন লেখিকা। সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে তিনি লেখেন, কেউ কেউ ফেসবুকে ‘অবকাশ’ ভাঙার ছবি পোস্ট করছে, দুঃখ করছে, স্মৃতিচারণ করছে। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সেই ‘অবকাশ’। ময়মনসিংহ শহরের টি এন রায় রোডে আমার বাবার কেনা সুন্দর বাড়িটি অবকাশ।
এই অবকাশ ভেঙে গুঁড়ো করার সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই, আমার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু এটুকু জানি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব লোভী, স্বার্থপর, ধুরন্ধর, কট্টর মৌলবাদী। সকলেরই আমি চক্ষুশূল। এককালে শহরের সাহিত্য-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রগতিশীলতার একটি কেন্দ্র ছিল যে বাড়িটি, আজ সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
তিনি আরও লেখেন, ‘ও বাড়ির এখন আমি কেউ নই। আমি তো তিরিশ বছর ব্রাত্যই। ইট-পাথরে, চুন-সুরকিতে, কাঠে কংক্রিটে স্মৃতি থাকে না, স্মৃতি থাকে মনে। অবকাশ রইলো আমার মনে। যে বাড়িটিতে বসে আমি প্রথম কবিতা লিখেছি, প্রথম কবিতা-পত্রিকায় ছাপিয়েছি, প্রথম কবিতার বই লিখেছি, নির্বাচিত কলাম লিখেছি, যে বাড়িটির মাঠে প্রথম গোল্লাছুট খেলেছি, যে বাড়িটির ছাদে প্রথম পুতুল খেলেছি, যে বাড়িটির ভেতর প্রথম রবীন্দ্রনাথ আওড়েছি, উঠোনজুড়ে নেচে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ করেছি, যে বাড়িটিতে দাদা বেহালা বাজাতো, ছোটদা গিটার বাজাতো, বোন গান গাইতো, মা আবৃত্তি করতো, বাবা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতো, যে বাড়িটিতে বসে প্রথম প্রেমের চিঠি লিখেছি, যে বাড়িটিতে আমি একই সঙ্গে সংবেদনশীল এবং সচেতন মানুষ হয়ে উঠেছি, সে বাড়িটি রইলো আমার মনে। কোনো হাতুড়ি-শাবল-কুড়োলের শক্তি নেই সে বাড়িটি ভাঙে।’