ডিসেম্বর ধামাকা! অশুভ শক্তির বাধা টপকে হলদিয়ার বিদ্যুৎহীন গ্রামে পড়ল বিদ্যুতের খুঁটি

আজ, বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের খুঁটি পড়তে শুরু করল বিষ্ণুরামচকের মাটিতে। বড় বড় ট্রাকে এলো বিদ্যুতের খুঁটি। যেমন কথা তেমন কাজ

অন্ধকার জীবন থেকে এ যেন মুক্তির স্বাদ। এবার আলোর কক্ষপথে অবসান হওয়ার মুখে দীর্ঘ বঞ্চনা। অসহায় মানুষগুলির জীবনে পূরণ হতে চলেছে আলোর স্বপ্ন। অশুভ শক্তির বাধা উপেক্ষা করে আলোর পথে দিশারি হলদিয়ার বিদ্যুৎহীন দুই গ্রাম। কুণালের ফোন, প্রতিশ্রুতি নয়, কথা রাখলেন মানবিক বিদ্যুৎমন্ত্রী। রাজ্য বিদ্যুৎ দফতর হলদিয়া পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদ্যুৎহীন গ্রামে শুরু করে দিলো আলো পৌঁছনোর কাজ। আজ, বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের খুঁটি পড়তে শুরু করল বিষ্ণুরামচকের মাটিতে। বড় বড় ট্রাকে এলো বিদ্যুতের খুঁটি। যেমন কথা তেমন কাজ।

ঘটনা গত ৪ ডিসেম্বরের। ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে শিল্পনগর হলদিয়ার পুরসভা অঞ্চলে বন্দর থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে বিদ্যুৎহীন দুই গ্রামের দুর্দশার বিষয়টি বিদ্যুৎমন্ত্রীর গোচরে সর্বপ্রথম এনেছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। কুণালের আবেদনে সাড়া দিয়েও রবিবার ছুটির দিনে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। হলদিয়া পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদ্যুৎহীন অরূপ বিশ্বাস। দুটি গ্রামে ওইদিনই বিদ্যুৎ দফতরের প্রতিনিধিরা যান। পরদিন অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর, সোমবার সাতসকালে সেখানে যায় বিদ্যুৎ দফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পদস্থ আধিকারিকের নেতৃত্বে টিম। বন্দরের জমি সংক্রান্ত আইনি জটিলতা আছে কিনা সেটা তাঁরা খতিয়ে দেখেন।

ঠিক কীভাবে কুণাল ঘোষের নজরে বিষয়টি আসে? গত ৩ ডিসেম্বর কাঁথিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভার পর রাতেই হলদিয়ার ফ্ল্যাটে আসেন কুণাল। পরেরদিন সকালে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে হলদিয়ায় চায়ের আড্ডা থেকে স্থানীয় যুবকদের কাছে বঞ্চনার কথা শুনে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ তখনই ছুটে যান ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। দেখেন বন্দর থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বের এই ওয়ার্ডের দুটি গ্রাম বিষ্ণুরামচক এবং সৌতনপুরে বিদ্যুতের খুঁটি ঢোকেনি। স্বাধীনতার এতবছর পরেও অন্ধকারে ডুবে গ্রামবাসীরা। দেখে অবাকই হলেন কুণাল।

বিন্দুমাত্র দেরি না করে গ্রামে দাঁড়িয়েই কুণাল বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের কাছে ফোনে বিষয়টি তুলে ধরেন। ব্যাস, ম্যাজিকের মতো কাজ। দিনটা ছিল রবিবার, ছুটির দিনেও কুণালের অনুরোধে অরূপ বিশ্বাস তৎপরতার সঙ্গে পদক্ষেপ নেন। কয়েক ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। গ্রামে এসেও কথা বলে যান সংশ্লিষ্ট দফতরের দুই আধিকারিক। শুধু তাই নয়, ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রামে ইন্সপেকশনও করা হয়। তাঁদের রিপোর্ট পাওয়ার পরই বিদ্যুৎমন্ত্রীর নির্দেশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ শুরু।

কুণালের কাছে স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল, হলদিয়া শিল্পতালুক হলেও পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের মানুষ এখনও বিদ্যুতের আলো দেখেননি। স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বন্দর থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে কোথাও মাটির কাঁচা রাস্তা, কোথাও আবার আবার অবহেলায় পড়ে রয়েছে অর্ধনির্মিত কংক্রিটের রাস্তা। ভোট আসলেই রাজনৈতিক নেতাদের শুধু প্রতিশ্রুতির বন্যা। এমন অনুন্নয়ন বঞ্চনা এবং অবহেলার জন্য স্থানীয় মানুষজন সরাসরি শুভেন্দু অধিকারীকে দায়ী করেছেন। একইসঙ্গে পুরসভার এই ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের অনুন্নয়নের জন্য পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ শ্যামল আদকের দিকেও আঙুল তোলেন তাঁরা। কুণালকে হাতের কাছে পেয়ে গ্রামবাসীরা বলতে থাকেন, “দাদা এবার কিছু একটু করুন, আমরা খুব কষ্টে আছি। শুধু ভোটের সময় নেতারা আসে, প্রতিশ্রুতি দেয়। আর ভোট চলে গেলে কেউ ফিরেও তাকায় না।” কুণাল গ্রামের ভিতর হাঁটতে হাঁটতে সেই দুর্দশার ছবি দেখেন। এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে দাঁড়িয়েই বিদ্যুতের জন্য ফোন করেন বিদ্যুৎমন্ত্রীকে। দুই বিদ্যুৎ না যাওয়া গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য গ্রামবাসীদের কাছে ফর্ম বিলি শুরু হয়।

তবে কাজটা সহজ ছিল না। হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদকে চিঠি দিয়ে জানয়, পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিষ্ণুরামচক ও সৌতানপুরে বিদ্যুতের খুঁটি বসানো যাবে না। পাল্টা বিদ্যুতমন্ত্রীর অরূপ বিশ্বাসের দাবি, ওই দিয়ে গ্রামে বিদ্যুৎ দেওয়ার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা চলবে। প্রয়োজনে জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে যতদূর যেতে হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যাবে। আইনি পথে লড়াই হবে। কিন্তু আর অন্ধকারে থাকবেন না গ্রামবাসীরা।

এরপর গত, শুক্রবার বিষ্ণুরামচকে গ্রামবাসীদের মধ্যে বিদ্যুৎমন্ত্রীর সেই বার্তা দিতেই হাজির হয়েছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। গ্রামবাসীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাতে বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কুণালের পাল্টা হুঁশিয়ারি, কেন্দ্রীয় বাহিনী বা সিআইএসএফ দিয়ে বিদ্যুৎ দেওয়ার কাজে বাধা মানা হবে। তৃণমূল নেতৃত্বকে টপকে গ্রামে ঢুকতে হবে বাহিনীকে। গ্রামবাসীদের মধ্যে সাহস জোগাতে বিষ্ণুরামচকের ভরা গ্রামসভাতে কুণালের ঘোষণা ছিল, “স্বাধীনতার এতদিন পরেও আপনাদের ঘরে বিদ্যুতের আলো নেই। আপনাদের প্রতি এটা বঞ্চনা লজ্জার। তবে বিদ্যুৎন্ত্রীর সক্রিয় পদক্ষেপে যতটা দ্রুত সম্ভব এই গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ফর্ম দিলে শুরু হয়েছে। আপনারা ফর্ম ফিলাপ করে সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দিন। ন্যূনতম খরচে মানুষের বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। এই কাজের জন্য কাউকে একটি নয়া পয়সাও দেবেন না। এটা সরকারের কাজ সরকার করবে। দীর্ঘ বাম জামানা, তারপর শুভেন্দু আপনাদেরকে শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে। আপনাদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোট নিয়েছে। কিন্তু কাজ করেনি। এখন গ্রামে বিদ্যুৎ আসবে। এখানে কোনও রাজনীতি নেই। বিদ্যুৎ যেমন তৃণমূল বাড়িতে পৌঁছবে, তেমনি বিজেপি-সিপিএম সমর্থকদের বাড়িতেও পৌঁছবে। তাই এটা নিয়ে অযথা কেউ রাজনীতি করবেন না, সকলে সহযোগিতা করুন।”

এরপরে কুণাল গ্রামবাসীদের জানান, “গ্রামে যাতে বিদ্যুৎ না পৌঁছায় তার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ দফতরকে চিঠি দিয়েছে। তারা বলেছে এই দুটি গ্রামে বিদ্যুৎ দেওয়া যাবে না। কিন্তু আপনাদের কাছে বিদ্যুৎ আসবেই। কারণ, সুপ্রিম কোর্টে বলেছে, জমি সংক্রান্ত কোনও জটিলতা থাকলে সে মামলা তার মত চলবে, কিন্তু সেই জমিতে বসবাসকারী কোনও মানুষকে বিদ্যুৎ ও আলো থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সুতরাং, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। কোনও অপপ্রচারে কান দেবেন না। বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় ফরম ফিলাপ করুন। মামলা হলে রাজ্য সরকার লড়বে। রাজনীতি হলে আমরা লড়ব। আর যারা বাধা দিচ্ছে তাদের বাড়িগুলো চিহ্নিত করে রাখুন, গ্রামে বিদ্যুৎ ঢুকলে আমি নিজে হাতে প্রথমে সেই বাড়িগুলিতে মিষ্টি নিয়ে যাব। বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে এনে প্রথম আলো জ্বালাবো গ্রামে।”

প্রসঙ্গত, বন্দর থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে হলদিয়া পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের দুটি বঞ্চনার গ্রাম বিষ্ণুরামচক এবং সৌতনপুর। স্বাধীনতার পর থেকে যেখানে বিদ্যুৎ আসেনি। দীর্ঘ বামজমানা এবং পরবর্তীকালে অধিকারীরাজ, বারবার আবেদন ছিল নিষ্ফলা। অন্ধকারে ডুবে দুই গ্রামের মানুষ। পদক্ষেপ শুরু হয়। আলোর স্বপ্ন দেখা শুরু করে গ্রামবাসীরা। এবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে।

Previous articleবিতর্কে কাতার বিশ্বকাপ! ফাইনাল ম্যাচের স্টেডিয়ামেই নিরাপত্তাকর্মীর মৃ*ত্যু
Next articleসুবীরেশের হাজিরায় কেন ১০ দিন সময়, জেলা আদালতের কাছে রিপোর্ট তলব হাইকোর্টের