কেমন আছিস রে? উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ দু’রকম বন্ধু আছে পৃথিবীতে :

একজন ভিজিটিং আওয়ারে আসে
ফিরে যায় সূর্যাস্তের আগে।
অন‍্যজন বসে থাকে হাসপাতালের গেটে
অনন্ত দুঃখের রাত জাগে। ‘
( সমুদ্র সংলাপ,
রণজিৎ চক্রবর্তী )

কে কার বন্ধু? খুব সহজ নাকি বন্ধু হওয়া? কে ও কারা সেই সৌভাগ্য লাভ করে? বন্ধু পাওয়ার চেয়ে বন্ধু হওয়া আরও কঠিন। বন্ধু চিনে নিতে এক জীবন যথেষ্ট নয়।

‘ বন্ধু পাওয়া ভীষণ কঠিন
বন্ধু হওয়া আরও ;
তবুও ছাই উড়িয়ে দেখো
পেলেও পেতে পারো। ‘

সঙ্গী, সাথী, সখা, সখী, সহযাত্রী ইত্যাদি শব্দসমূহ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু ‘ বন্ধু ‘ শব্দটির সংজ্ঞা ও স্বরূপ নিয়ে তর্কের শেষ নেই। কারণ,এটি একটি গুরুভার শব্দ। বিশাল এর ব‍্যাপ্তি। অফুরান এর প্রাণশক্তি। যুগ যুগ ধরে চাঁদ, ফুল ও জোছনা নিয়ে যত গান ও কবিতা রচিত হয়েছে পৃথিবীতে, সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি চর্চিত শব্দ ‘ বন্ধু ‘। প্রকৃত বন্ধু চিনতে চিনতে আয়ু ফুরিয়ে আসে। সাধারণ থেকে বিদ্বজ্জন সকলেই বন্ধুর প্রকৃত অর্থ নির্ধারণে অক্লান্ত।

তোমার অনুপস্থিতিতে যে তোমার হয়ে লড়াই করে সে-ই তোমার বন্ধু। সেই লড়াই ঠিক কেমন? মহাকাব‍্যের সপ্তরথীবেষ্টিত চক্রব‍্যূহে সম্পূর্ণ একা যিনি অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেই বীর অভিমন‍্যুর মরণপন-মর্মান্তিক- বিয়োগান্তিক লড়াই।
বন্ধুত্বের চড়াই-উৎরাই, ভূত-ভবিষ‍্যৎ, সাধনা ও যাতনার সমস্তটুকু কে-ই বা ঠিকঠাক বোঝে! পথেঘাটে, হাটেমাঠে, বাজারে ও চায়ের দোকানে তোমার একফোঁটা নিন্দাও যে সহ‍্য করতে পারে না, সে তোমার বন্ধু।

‘ আজি বিজন ঘরে
নিশিথ রাতে
আসবে যদি শূন্য হাতে,
আমি তাইতে কি ভয় মানি!
জানি, জানি বন্ধু, জানি
তোমার আছে তো হাতখানি।।’
এই হাতখানিই তো চাই প্রতিটি হৃদয়ের। এই সেই পরম আকাঙ্খিত ভালোবাসার হাত,যা ধরার সুযোগ না থাকলে জীবন শুষ্ক মরুর মতো। বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না। রবি ঠাকুরের কবিতায় ও গানে বন্ধু ও সখা স্বয়ং ঈশ্বর। কিন্তু লোকে বলে মা ও বাবার পরে ঈশ্বরের সেরা দান বন্ধু। যা অনেকেরই ভাগ‍্যে সারা জীবনেও জোটে না।

‘ বন্ধু তোমার পথের সাথীকে
চিনে নিও
মনের মাঝেতে চিরদিন
তাকে ডেকে নিও
ভুলো না তারে
ডেকে নিও তুমি… ‘
তোমার হাজার শত্রুর বিরুদ্ধে একা, সম্পূর্ণ একা লড়াই করে চলে তোমার বন্ধু তোমার চোখের আড়ালে। তুমি তা জানতেও পারো না।

বন্ধুকৃত‍্যের রণক্ষেত্রে অতন্দ্র প্রহরী শুধুমাত্র তোমার মর্যাদারক্ষার্থে প্রাণপন যুদ্ধ করে। কোনো অবস্থাতেই রণক্ষেত্র ত‍্যাগ করে না।
রণে ভঙ্গ নৈব নৈব চ!

তোমার একটুখানি শ্বাসকষ্টের কথা এই মধ‍্যরাতে মুঠোফোনে একটু আগেই যাকে জানিয়ে
ব‍্যথার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছো তুমি
জেনেছো কি তার বাকি রাতের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার
বিনিদ্র উপাখ‍্যান?
তোমারই জন‍্য।
সেসবই শুধু তোমারই জন‍্য!
তাই তো গান : বন্ধু
রহো রহো সাথে…

রবি ঠাকুর লিখেছেন :
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় অনেক তফাৎ আছে। কিন্তু ঝট্ করিয়া সে তফাৎ ধরা যায় না। বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা থাকিলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই, গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সঙ্গ চাই। কিছুই যদি না পাই তবুও তাহাকে ভালোবাসি। বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুইজন ব‍্যক্তি এবং একটি জগৎ। অর্থাৎ দুইজনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। বন্ধুত্বের উঠিবার নামিবার স্থান আছে। কারণ, সে সমস্ত স্থান আটক করিয়া থাকে না।

‘ আমার কিছু বন্ধু আছে
ভালোমন্দ পাঁচমিশালী
নানারকম খামখেয়ালী
আমার কিছু বন্ধু আছে।…

তাদের মনে ছন্দ আছে
ভালোবাসার গন্ধ আছে
রোজনামচার ধন্ধ আছে
আমার কিছু বন্ধু আছে।…

বন্ধু মেঘে ঢাকা অন্ধকার মনে হঠাৎ ফুটে ওঠা একরাশ আলো। বন্ধু, কেবলমাত্র বন্ধুই পারে কালের ওজনে নুয়ে পড়া পিঠে হাত রেখে শৈশব ও কৈশোরের নানা রঙের দিনগুলি কয়েক মুহূর্তের জন‍্য ফিরিয়ে দিতে। বার্ধক‍্যে জরাজীর্ণ হাতে হাত রেখে যৌবনের উপবনে স্বপ্নমাখা বিকেলগুলোর উষ্ণ স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে বন্ধুর বিকল্প কোথায়? আমি তো সুদামা,
তুই কৃষ্ণ হ, তুই কৃষ্ণ হ।

উৎসবে ব‍্যসনে চৈব
দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শ্মশানে চ
যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ ।
এমন বন্ধু পাওয়া কি মুখের কথা! বন্ধু তাদেরই বেশি জোটে যারা বন্ধু হতে জানে।
একথাও খুবই সত‍্য যে বন্ধু হওয়া ও পাওয়া দুটোই ভীষণ কঠিন। তাই তো বন্ধুত্ব প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপহার।
গাঙ পার হইতে ছয় আনা,
ফিরা আইতে ছয় আনা,
আইতে যাইতে বারো আনা উসুল হইলো না…
কেন উসুল হলো না? কারণ পরপর তিন দিন বন্ধুর বাড়িতে গিয়েও বন্ধুর দেখা পাওয়া গেল না।

এই লোকগান যদিও প্রেমের, তবুও এখানে বারো আনা উসুল না হওয়ার আক্ষেপ খুবই মনছোঁয়া। বন্ধুত্বও তো প্রেমেরই অন‍্য নাম। এই গান আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় যে পথ যতই

‘ বন্ধুর ‘ হোক না কেন বন্ধুর দেখা পাওয়ার দুর্মর বাসনায় হাজার মাইল হেঁটে যাওয়া যায় অনায়াসে। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা হওয়া চাই-ই চাই। তাহলেই সমস্ত দুঃখের অবসান। তাই তো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ও তাপিত জীবনের যাত্রাপথে তৃষিত প্রাণ জুড়োতে মাঝেমাঝেই বন্ধুর কোমল পরশখানি বড়ই কাঙ্খিত। বন্ধুত্বের চেয়েও মূল‍্যবান পার্থিব সম্পদ আর কিছু হয় নাকি?

আরও পড়ুন- শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিস্ফোরক অভিষেক, নাম না করে কাকে নিশানা!

 

 

 

 

Previous articleশিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিস্ফোরক অভিষেক, নাম না করে কাকে নিশানা!
Next articleকালকে দিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নজর রাখুন: ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য অভিষেকের