লেক ক্লাবের নাট্যমেলায় ‘হাবিব একাই একশো ‘ জমজমাট

হাবিব তানভীর এই পটভূমিতে তার নাট্যচর্চায় এক সম্ভাবনার প্রয়োগ রূপায়ণ সম্পন্ন করেছেন। ভারতের নানা অঞ্চলে গ্রাম-শহরের বিচ্ছেদ বাস্তবতা বিবিধ, ভিন্নতর

হাবিব তানভীরের জন্মশতবর্ষে তার কাজের আঙ্গিক ও চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল লেক ক্লাব। সোমবার সপ্তম লেক ক্লাব নাট্যমেলায় ‘হাবিব একাই একশো ‘ শীর্ষক আলোচনায় পরিচালক-অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেন, গতশতকের চল্লিশের দশকের শেষ থেকে উপমহাদেশে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ চর্চার সূত্রপাত ঘটে। শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাট্যের প্রয়োগ-রূপায়ণে সম্ভব করে তোলেন এক মুক্তধারা। ষাটের দশক থেকে এই ভাবন-বীজ উপমহাদেশজুড়ে রোপিত, ব্যাপ্ত প্রয়োগধারাপাত ঘাটায়। উৎপল দত্তও যাত্রায় উৎসাহী হন।হাবিব তানভীর এই পটভূমিতে তার নাট্যচর্চায় এক সম্ভাবনার প্রয়োগ রূপায়ণ সম্পন্ন করেছেন। ভারতের নানা অঞ্চলে গ্রাম-শহরের বিচ্ছেদ বাস্তবতা বিবিধ, ভিন্নতর। সুমন মুখোপাধ্যায় বলেন, চল্লিশের দশকে গণনাট্য সংঘ সন্ধান আর সূত্রপাত করে আরেক পন্থার। গ্রাম-নগরের এক বিনিময় মিথষ্ক্রিয়ায়। উপমহাদেশজুড়ে নাট্যের এক বিচিত্রবীর্য স্বদেশযাত্রার উদ্বোধন তাতে ঘটে। যদিও পতন-বন্ধুর সে যাত্রাপথ।

হিরণ মিত্র বলেন, ১৯৫৪ সালের ‘আগ্রাবাজার’ প্রয়োজনার পেছনেও আছে লোক-সংস্কৃতির প্রেরণা। তবুও ১৯৬৪ ও ১৯৭০-এর প্রযোজনায় অনিবার্যভাবে কিছু পার্থক্য, কিছু তফাৎ ছিল। ফোক-ফর্মের ব্যবহারে হাবিব তানভীরের অভিজ্ঞতা আমাদের জানিয়েছে প্রকৃত লোক-অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করানোর সময় কী করতে হবে। লোক অভিনেতাদের বাদ দিয়ে নাটকে একটা শহুরে চেহারা কেউ দিতে পারে। কিন্তু একজন শহরের নাট্যকার যদি একই ভাবনায় চলেন, লোক-ঐতিহ্যের কথাটা মাথায় রেখে, লোক-অভিনেতাদের যদি কাজে লাগান তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি অনেক বেশি সুফল পাবেন।

সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নাটক কিন্তু লোক-আঙ্গিক। সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংযোগ সেখানে এই আঙ্গিকের কার্যকারিতা যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক।

হাবিব কন্যা নাগীন তানভীর বলেন, বাবা ১৯৪৫ সালে বোম্বের গণনাট্য সংঘে একজন অভিনেতা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে নয়াদিল্লির হিন্দুস্থানি থিয়েটারে যোগ দেন। একই সঙ্গে চিলড্রেন থিয়েটারে কাজ করেন, সেখানে প্রচুর নাটক লেখেন। ১৯৫৪ সালেই তার প্রথম বিশিষ্ট প্রযোজনা ‘আগ্রাবাজার’ মঞ্চস্থ হয়। এই নাট্যে তিনি স্থানীয়জন এবং দিল্লির ওখলা গ্রামের লোকশিল্পীদের যুক্ত করেন। জামিয়া মিল্লা ইসলামিয়ার ছাত্ররাও যোগ দেয়। এই সমন্বয় ভারতীয় থিয়েটারে প্রথম দেখা গেল।

শূদ্রক-এর ‘মৃচ্ছকটিক’ অবলম্বনে ‘মিট্রি কা গাড়ি’ ছত্তিশগড়ী রীতিতে নির্মাণ করেন। ৬জন লোকশিল্পী এতে কাজ করেন। এরপর আর তিনি পেছনে ফিরে তাকান নি। মধ্য প্রদেশে ভোপালে ১৯৫৯ সালে পত্তন করেন ‘নয়া থিয়েটার’। ১৯৭০-৭৩ ছিল তাঁর প্রয়োগ-নিরীক্ষাকাল। তাঁর সকল প্রযোজনায় হিন্দী ও ছত্তিশগড়ী ভাষার যুগপৎ ব্যবহার শুরু হয়। স্থানীয় লোকসঙ্গীতরীতি ‘পাণ্ডবাণী’ নিয়েও তিনি কাজ করেন। ১৯৭২ সালে ছত্তিশগড়ী নাছরীতিতে ‘গাঁও কা নাম শ্বশুরাল’ প্রযোজিত করেন। ১৯৭৫ সালের ‘চরণদাস চোর’ ভারতীয় নাগরিক থিয়েটারে অভিনব এক নাট্যপ্রয়োগ। নাটকটি শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় চলচ্চিত্রায়িত হয়। এছাড়া তিনি ৯টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। আটেনবোরার ‘গান্ধী’, ‘ব্লাক এক হোয়াইট’ প্রভৃতিতে।

বাবরি মসজিদ ভাঙন-পরবর্তীকালে ১৯৯০ সালে ধর্মীয় প্রতারণামূলক ঐতিহ্যবাহী ছত্তিশগড়ী নাটক ‘পোঙ্গা পণ্ডিত’-এর নবভাষ্য তুমুল প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করে। যদিও তিরিশের দশকে ছত্তিশগড়ী থিয়েটার আর্টিস্ট এই লোককথা-নির্ভর নাটক করেছিল। এবং তিনিও এটি ষাটের দশক থেকে করে আসছিলেন।

সমগ্র নাট্যজীবনে তিনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিবিধ ঐতিহ্যের উপস্থাপন করেন। সংস্কৃত নাট্যকার শূদ্রক, ভাস, বিশাখদত্ত, ভবভূতি যেমন তেমনি ইউরোপীয় ধ্রুপদী শেক্সপীয়র, মলিয়ের, গলডনি; আধুনিক মহাজন ব্রেশট, লোরকা, গর্কি, অস্কার ওয়াইল্ড; ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ, আসগর ওয়াজাহাট, শংকর শেস, সফদার হাসমী, রাহুল ভার্মা, প্রেমচাঁদের গল্প। ছত্তিশগড়ী লোককথা তো বটেই।
প্রসঙ্গত, হাবিব তানভীর তাঁর আত্মজীবনী রচনা করছিলেন ঊর্দুভাষায়। হাবিব তানভীর সঙ্গীত নাটক আকাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৯ সালে, পদ্মশ্রী ১৯৮৩ সালে, কালিদাস সম্মান ১৯৯০-এ, সংগীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ ১৯৯৬-এ, পদ্মভূষণ ২০০২-এ।
১৯৮২ সালে ‘চরণদাস চোর’ এডিনবরা আন্তর্জাতিক নাট্যউৎসবে ফ্রিনস ফার্স্টস এওয়ার্ড অর্জন করে। ২০০৭ সালে ব্রেশট ও লোকপ্রকরণের অভিনব নাট্যবাচন উদ্ভাবনায় তাঁকে সম্মাননা দেয়া হয়।

হাবিব তানভীরের স্বীকৃতি বিশ্বজুড়েই ঘটেছে। তবে নিছক কোনো জাতীয়তাবাদী প্রণোদনায় তা সম্পন্ন হয় নি।

Previous articleপন্থের জন‍্য বিশেষ বার্তা হার্দিকের, সুস্থ হয়ে মাঠে ফিরুক ঋষভ, বললেন টি-২০ অধিনায়ক
Next articleফের শহরে উদ্ধার লক্ষ লক্ষ টাকা, গ্রেফতার ৮