‘তোমার মতো গভীর’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ন্যাংটো ছেলে আকাশে
হাত বাড়ায়
যদিও তার খিদেয় পুড়ছে গা
ফুটপাতে আজ লেগেছে জোছনা ;
চাঁদ হেসে তার কপালে
চুমু খায় ।
লুকিয়ে মোছেন চোখের জল
মা । ‘
লেখাটি আদৌ কবিতা হয়ে উঠলো কিনা অথবা কবিতাটি আদৌ শিল্প হয়ে উঠলো কিনা তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা কোনোদিনই ছিল না কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের । কবিতার ছলে তিনি দিতেন বার্তা । সময়ের বার্তা । দেশ-কাল-সমাজের বার্তা । আসলে তো সবই রাজনৈতিক বার্তা । ছদ্মবেশ কিংবা নিরপেক্ষতার ভান বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় পাওয়া যাবে না । তিনি অকপট , তিনি অকৃত্রিম ।
একটা ছবির কথা বলা যাক ।

প্রবাসে নিঃসঙ্গ অবস্থায় পথে প’ড়ে থাকা এক চরম দরিদ্র মজুরের ছবি, যার পায়ের গোড়ালি একেবারে ফুটিফাটা । সেই দগদগে ক্ষতগুলোর ওপরে পড়েছে চাঁদের আলো । সোনালী আলোয় দেখে মনে হয় সোনায় মোড়ানো মজুরের পা ! দারিদ্র ও বিপন্নতা এখানে শিল্প হয়ে উঠলো অবশ্যই । তবে তার চেয়েও বড়ো হয়ে জেগে রইলো একটা বার্তা । একটা সময় ।

সেই অন্ধকার সময়ের গায়ে লেখা রইলো ঘরছাড়া মজুরদের ভয়াবহ অসহায়তা । বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে থাকা অবস্থা । এও তো একরকম ‘প্রবাসে, দৈবের বশে ‘ প্রাণ নিয়ে টানাটানি ।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শাহিদুল আলম তুলেছিলেন ছবিটি । ফাটা পায়ে আলো প’ড়ে অদ্ভুত এক মেজাজ সৃষ্টি করে । মনে হয় খুব সাধারণ জিনিসের মধ্যে সৌন্দর্য দেখাই তো শিল্পীর কাজ । আর চূড়ান্ত শিল্পবোধে জারিত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা প’ড়ে দীক্ষিত পাঠকের মনে হয় শিল্পী হওয়ার চেয়েও কবির অনেক বেশি মনোনিবেশ ছিল মানুষ হয়ে ওঠার প্রতি । মানুষের জন্য লেখা কবিতায় যদি মনুষ্যত্বে উত্তোরণ ও মানবিক আলোর দেখাই না পাওয়া যায় তবে কবিতা লিখে কী লাভ ?
‘ যারা কথা বলছে তারা বোবা
যারা শুনছে সকলেই
জন্ম থেকে বধির । অথচ সভায় মিছিলে তিলধারণের ঠাঁই নেই ।

যারা উপস্থিত তারা
বহুদিন মৃত
কিন্তু সকলেই হাততালি দিচ্ছে
কী জন্য এবং কাকে
একজনও জানে না । ‘
এই কবিতায় রাজনৈতিক
হিমযুগের ছবি পাওয়া যায় ।
যখন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ
জনগণ স্বার্থসর্বস্ব ও চরম সুবিধাবাদী হয়ে ওঠে তখন এই ছবি ছাড়া অন্য কী-ই বা আঁকবেন কবি ? কেবল চাঁদ , ফুল আর জোছনার গান গেয়ে কীভাবে কাটতে পারে একটা দীর্ঘ কবিজীবন ? অবশ্যই এর উত্তর জানেন নিরপেক্ষ কবিগণ । কিন্তু , বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , যিনি লিখে গেছেন , ‘ আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে ‘, যিনি লেখেন , ‘ কারা যেন আজও ভাত রাঁধে , ভাত খায় ‘, তিনি তথাকথিত ‘ অরাজনৈতিক ‘ থাকার ভণ্ডামি কখনোই করবেন না এতো জানা কথা । তিনিই তো অবধারিত লিখবেন :
‘ রূপসী তুই রাজনীতি , দিস
ছেলে-ছোকরার মাথা ঘুরিয়ে ;
কিন্তু বুড়ো-শয়তানদের সঙ্গে
থাকিস রাত্রে শুয়ে । ‘

‘ কলম কখন চাবুক হয়ে উঠবে কখন হবে তুলি , আর কখন হবে স্টেনগান সেটা ভালোভাবে জানতে হলে আপনারা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে যান । ‘

কবির সমসাময়িক আরেক কবির ভাষ্য এটি । অসামান্য মূল্যায়ণ । ‘ তিন পাহাড়ের স্বপ্ন ‘ দেখা এই মরমী কবি লেখেন , ‘ রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি ‘ । লেখেন , ‘ এ এক মন্ত্র ! রুটি দাও , রুটি দাও ; বদলে বন্ধু যা ইচ্ছে নিয়ে যাও । ‘

সারা পৃথিবীর ক্ষুধাতুর জনতার জন্য নিজের কলমটি উৎসর্গ করেছিলেন বীরেন্দ্র কবি । তা ব’লে হৃদয়ের কথা কিন্তু ভুলে যান নি । লিখেছেন :
আমি অনেক হৃদয় দেখলাম
তোমার মতো গভীর কেউ না
আমি অনেক কবিতা জানলাম
তোমার পলিমাটির মতো না ।

কবি লিখে গেছেন :
মানুষের আশা অবিনাশী ।
চারদিকের নরকের মধ্যেও মানুষ তাই স্বপ্ন দেখে । তখন ,
স্বয়ং মৃত্যু এসেও যদি তার সামনে দাঁড়ায় — সে তাকে সহজে পথ ছেড়ে দেয় না —
প্রশ্ন করে । প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয় , প্রশ্ন করাটাই হয়তো কবির ধর্ম ।

এই যুগন্ধর কবির কবিতা পরিক্রমার আর একটি গূঢ় অন্বেষণও এখানে উল্লেখ্য , আর , তা হলো , শেষ পর্যন্ত পায়ের নিচের মাটি কি খুঁজে পায় মানুষ ? না পেলে তো সভ্যতার সুদীর্ঘ পথযাত্রার পরিশ্রম একেবারেই বৃথা ।
‘ একটা পৃথিবী চাই
মায়ের আঁচলের মতো
আর যেন ঐ আঁচল জুড়ে
গান থাকে
যখন শিশুদের ঘুম পায় । ‘
মায়ের আঁচলঘেরা এই আলো – পৃথিবীর সন্ধানেই বোধহয় প্রতিটি মানুষের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত
‘ জন্মভূমির বর্ণপরিচয় ‘ :
মানুষ রে তুই সমস্ত
রাত জেগে
নতুন ক’রে পড় ,
জন্মভূমির বর্ণপরিচয় ।
আর হ্যাঁ , কেউ মানুক না মানুক সত্য অবিনশ্বর :
‘ চোখ রাঙালে
না হয় গ্যালিলিও
লিখে দিতেন ,
‘ পৃথিবী ঘুরছে না। ‘
পৃথিবী তবুও ঘুরছে ,
ঘুরবেও ;
যতই তাকে চোখ
রাঙাও না । ‘
অবিস্মরণীয় এই কবির পার্থিব প্রস্থানের পরে জনৈক অনুজ কবির শ্রদ্ধাজ্ঞাপন :
এতদিন যাঁর বুকে
ছিল আগুন
আজ তিনি আগুনের বুকে
এতদিন যাঁর বুকে
ছিল মানুষ
আজ তিনি মানুষের বুকে ।

আরও পড়ুন- উদ্দীপনার ঢেউয়ে সাগরসঙ্গমে শুরু হল মকরস্নান

 

Previous articleউদ্দীপনার ঢেউয়ে সাগরসঙ্গমে শুরু হল মকরস্নান
Next articleBreakfast news :. ব্রেকফাস্ট নিউজ