‘সোনালি কাবিন’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

এক )
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা
পরাজিত নই নারী ,
পরাজিত হয় না কবিরা ;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা ।

দুই )
এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী ,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে
এ মাটির গায় ,
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই
গ্ৰন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই
জীর্ণ তালের পাতায় ।

তিন )
মাৎস্যন্যায়ে সায় নেই , আমি
কৌম সমাজের লোক
সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী
তোমার নগরে ,
কোনো সামন্তের নামে
কোনোদিন রচিনি শোলোক
শোষকের খাড়া ঝোলে
এই নগ্ন মস্তকের ‘পরে ।

চার )
পোকায় ধরেছে আজ
এ দেশের ললিত বিবেকে
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত
পণ্ডিত সমাজ ।
ভদ্রতার আবরণে কতদিন
রাখা যায় ঢেকে
যখন আত্মায় কাঁদে কোনো
দ্রোহী কবিতার কাজ ?

পাঁচ )
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে
কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে
শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা ,
এশিয়ায় যারা আনে
কর্মজীবি সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো
এঁটে দিই বীরের তকোমা ।
আমাদের ধর্ম হোক
ফসলের সুষম বণ্টন ,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে
গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ ,
এমন প্রেমের বাক্য
সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে
লোকধর্মে আর ভেদাভেদ ।
( সোনালি কাবিন ,
আল মাহমুদ )

‘সোনালি কাবিন ‘ কাব্যগ্ৰন্থের কবিতাগুলি নামহীন । সর্বমোট ১৪ টি কবিতা । যে কোনো কবিকে চিনে নিতে হলে তাঁর একটি কাব্যগ্ৰন্থই যথেষ্ট । এমনকি কখনো কখনও একটি কবিতাও একজন কবিকে চিনিয়ে দিয়ে যায় । সোনালি কাবিনের লেখাগুলো স্তবের মতো , শ্লোকের মতো , মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের মতো বাজতে থাকে আমাদের তৃষিত হৃদয়ের অন্তস্থলে ।
সোনালি কাবিনের বাইরেও আল মাহমুদ রেখেছেন অজস্র বিস্ময় । যেমন
‘ তরঙ্গিত প্রলোভন ‘ কবিতাটি:
পীরের মাজারে বসে
কোনো রাতে বাউলের দল
যেমন হঠাৎ ধরে
হুহু শব্দে প্রেমের জিকির
আমার কবিতা সেই
মত্তদের রাতের গজল
তোমার শ্রবণে দিক
কলজে ছেঁড়া কথার তিমির ।

কে বিদ্রোহী আলো জ্বালো
দীর্ণ জনপদে ?
আমাকে দেখাও মুখ
অন্ধকার রাত্রির বিপদে ।

একান্ত নিজস্ব কাব্যভাষায় আল মাহমুদ এঁকে গেছেন আশ্চর্য সব ছবি । ভোরের সহজ আলোর মতো তাঁর অপূর্ব উপলব্ধি ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের অন্তরে । তাঁর মগ্ন চৈতন্য কবিতার গহন পথে কান্তিময় আলো ছেটাতে থাকে সততই ।

প্রেয়সী তোমাকে ছাড়া কবিতার আর মৌল বিষয়
খুঁজি না ।
একদা প্রকৃতি ছিল ,
ছিলো দেশ , সময় সুদিন
জয়-পরাজয়ে স্তব্ধ আত্মার দুলুনি ছিল বুকের ভেতরে
অবিশ্বাসী লাল চোখে
নুনের ছিটার মতো
মনে হতো যাকে
আজ সেই তুমি ছাড়া
সৌন্দর্যের অন্য কোনো
তুলনা কি আছে ?

ভালোবাসার অন্তহীন অন্বেষণ কবির স্বভাবজাত । তারই সঙ্গে সম্পর্কের আলো-আঁধার , ক্ষোভ-বিক্ষোভ , প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ , দ্রোহ ও ধিক্কার হাত ধরাধরি করে চলতে থাকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে ।
যতই অসহ্য এই
ঘাম ঝরে যত
ফুটপাত তেতে ওঠে
সারাদিন রোদে
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরি
ক্ষতবিক্ষত ।
অন্তহীন যন্ত্রণায় রক্ত জ্বলে বুঝি ।
তারপর নষ্ট এক
গনিকার মতো
অন্ধকার ডাক দেয়
নিবিড় প্রবোধে :
আসুন বাবুজী ।

অথচ স্বপ্ন দেখা এই কবি কোনো অবস্থাতেই স্বপ্নের সোলালি হাত ছাড়তে রাজি নন ।
স্বপ্নের আঘাতে আমি
সারারাত ঘুমাতে পারি না
অথচ বালককালে মা আমার
দক্ষিণ বাজুতে
রুপোর মাদুলি তুই বেঁধেছিলি
স্বপ্ন না দেখার ,
তবু কেন জননী গো
খোয়াবের অসুখ সারে না !

বাংলা কবিতার পুনরুজ্জীবনের অন্যতম কারিগর আল মাহমুদের কবিতা আমাদের শুষ্ক তাপদগ্ধ ভ্রান্তিময় কাব্যানুভূতির মরুতে পরম শুশ্রূষার জলধারার মতো । এই কথা বলেছেন কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন গভীর প্রত্যয়ের কথা লিখতে গিয়েও আল মাহমুদকে কখনও জঙ্গীভাব দেখাতে হয় নি । তাঁর প্রত্যেকটি শব্দই অবধারিত । প্রচলিত শব্দের একঘেয়েমি কাটাতে তিনি কথ্য ও গ্ৰাম্য শব্দ ব্যবহার করেছেন স্বাধীনভাবে ।
জীবনের ঘোর বাস্তবতা বুঝে নিতে কঠোর সত্যের মুখোমুখি তাঁর প্রিয় স্বপ্নকে দাঁড় করাতেও দ্বিধাহীন তিনি ।

মে সব ভারসাম্যহীন মানুষ
সত্যের চেয়ে স্বপ্নকে
বড়ো বলে ভাবতো , একদা আমি ছিলাম তাদের দলে ।
আজকাল বাতি নিভিয়ে ঘুমোতে পর্যন্ত সাহস হয় না ।

এরই পাশাপাশি আসে তাঁর মগ্নমোহন উচ্চারণ আগামীকে ভালোবেসে :
ঝরুক পাতা পুরনো পাতা
হলুদ পাতা ঝরুক
বীজের মুখে সবুজ কুঁড়ি
অবুঝ মাথা গড়ুক ।

আগের সব কবিরা এই
মাঘের শীতে পালাক
তরুণ কেউ প্রেমিক এসে
নতুন গান ঝালাক ।
বিশ্বব্যাপী ভ্রাম্যমান এই কবির আশ্চর্য মনন । ঘরে বাইরে ছড়ানো শব্দের বিপুল মণিমুক্তা । আর ফিরে ফিরে অব্যর্থ আত্মবীক্ষণ ।

নিসর্গ , দেশ-কাল-সমাজ ও সংসার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এঁর কবিতায় । সময় যত গড়াবে ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকবেন এই মরমী কবি । বিশ্বময় দিব্যজ্যোতি ছড়িয়ে মন্ত্রের মতো বাজতে থাকবে তাঁর হিরন্ময় পংক্তিগুলি ।

আমরা প্রতীকহীন
হাতে কোনো পতাকা নিইনি ।
আমাদের সঙ্গে এক বাউলের
বিধবা যাবেন
উষ্ণ বয়সিনী এই বঙ্গ নাম্নী
বৈষ্ণবীটি ছাড়া
তৃষ্ণার রাস্তায় আর অন্য কোনো যুবতী যাবে না ।

আরও পড়ুন- কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিধানসভার অধিবেশনে প্রাইভেট বিল নিয়ে প্রস্তাব আনতে পারে সরকার

Previous articleশুরু বিয়ের কাউন্টডাউন! এ বার জয়সলমেরের পৌঁছলেন পাত্র সিদ্ধার্থ মালহোত্রা
Next articleম*ত্ত অবস্থায় বৌকে মা*রধর! বিনোদ কাম্বলির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের