‘মানা কি কুছ নহীঁ গালিব’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

হম ভি গুস্তাকি করেঙ্গে
জিন্দেগী মে এক বার
ইয়ার তো পয়দল চলেঙ্গে
হম জনাজে পর সওয়ার ।
ঔদ্ধত্য আমিও দেখাবো জীবনে একবার
বন্ধুরা সবাই হাঁটবে
আমি তাদের কাঁধে
হবো সওয়ার ।

হজারোঁ খ্বাহিশেঁ এয়সী কে হর খ্বাহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে মেরে অরমান
লেকিন ফিরভি কম নিকলে ।

এইসব শব্দের ধমনী ছেঁড়া অনর্গল রক্তপাত নিয়েই জীবন কাটিয়ে গেছেন আমাদের প্রিয় মির্জা গালিব ।
‘ গালিব ‘ শব্দের অনেক অর্থ । তারমধ্যে একটি হলো ‘ বিজয়ী ‘। শব্দটি ইসলামী , কিন্তু এসেছে ফারসি থেকে ।

মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব । ১৭৯৭ সালে আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন । ১৮১৩ সালে গালিব স্হায়ীভাবে দিল্লি চলে যান । তারপর দিল্লিতেই কাটান বাকি জীবন । নিজের বাড়ি কোনোদিন হয় নি তাঁর । ভাড়াটে হয়েই কেটেছে জীবন । গালিবের কালজয়ী শেরগুলির বিস্তারে যাওয়ার আগে তাঁর সমকালটি দেখে নেওয়া অতি আবশ্যক ।

তখন মোগল-মারাঠা-ইংরেজ—এই ত্রয়ী শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ভয়ঙ্কর লড়াই চলছে । একদিকে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার আওয়াজ , অন্যদিকে নতুন ইংরাজ সভ্যতার পদধ্বনি । কোন্ দিকে যাবেন গালিব ? দুদিকেই তাঁর টান । তাই বুঝি তাঁর কবিতায় একদিকে ভাঙনের , পোড়ো ঘরদোর ভাঙচুরের আয়োজন । ধুধু শূন্যতা । আবার অন্যদিকে তিনি টের পাচ্ছেন নতুন দিনের আগমনবার্তা । এই দোটানার কিনারায় দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতার আধুনিক রূপধারন । তাঁর কবিতা , এক কথায় , ধ্বস্ত নষ্ট ভঙ্গুরের শোকগাথা।
নহ্ গিলে নগমা হুঁ নহ্ পরদেসাজ্
ম্যায় হুঁ অপনি
শিকস্ত কী আওয়াজ ।
সুরের পর্দা নই কিছুতেই
নই তো গীতের সার
আমি শুধুই শব্দ
নিজের ভেঙে যাবার ।

ইতিহাসের আশ্চর্য পালাবদল স্বচক্ষে দেখেছেন গালিব । যুগ সন্ধিক্ষণের এই স্পর্শে কবির অবস্থা তখন ওইসব পোড়ার মধ্যে একা বাতির মতো চুপচাপ । গালিব ছিলেন গুরুহীন । ছিলেন স্বশিক্ষিত । তবে অগ্রজদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অসীম । লিখতেন অধিকাংশই ফারসিতে । তাঁর সমালোচকেরা চাইতেন গালিব লিখুন সহজ সরল ভাষায় সকলের জন্য । কিন্তু গালিব শব্দ নির্বাচনে ছিলেন দুর্গমতার পক্ষপাতী । তিনি ভাবতেন পাঠক হবেন দীক্ষিত । ভাবতেন সব উৎকৃষ্ট সকলের জন্য নয় । সুগন্ধি ফুল যেমন নামগোত্রহীন স্থানে ফুটলেও প্রকৃত রসিক তাকে ঠিকই খুঁজে নেয় , ঠিক তেমনি প্রকৃত পাঠকেরা কালজয়ী কবিতা ঠিকই খুঁজে নেবেন । তারজন্য অহেতুক আটপৌরে ও বহু ব্যবহারে জীর্ণ শব্দগুলি টেনে এনে কবিতার মর্মবস্তু নষ্ট হতে দেওয়া যায় না । এই আপসহীনতাই তাঁর শেরগুলিকে কালোত্তীর্ণ করেছে । গালিব জানতেন তিনি তাঁর সমকাল থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন । তিনি জানতেন যে তিনি লিখছেন আগামীর জন্য ।

হুঁ গরমিয়ে নিশাৎ-এ
তসৌঅর নগমা সনজ
ম্যায়ঁ আন্দলিব্-এ গুলশন-এ
না আফরিদা হুঁ ।
কল্পনার এই খুশির তাপে
গেয়ে চলেছি গান
যে কাননের পাখি আমি অজাত আজও সেই বাগান ।

১৮৫৭ সাল । সিপাহী বিদ্রোহ । দিল্লি ভাঙছে । মোগল আমলের পতনচিহ্ন ক্রমশ পরিস্ফুট হচ্ছে । তিনি ডায়েরী লিখছেন তখন । ভীষণ অন্ধকার দিনকাল । ঘোর দুঃসময় । এমন দিনে তাঁর পাগল ভাই ইউসুফ মারা যায় । রাতের আঁধারে গোর-কাফনে তাকে আরও গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পথে বেরোন গালিব ।এমন বিপন্ন সময়েও এই আশ্চর্য কবির অন্তরের রহস্যরসিকতা যেন যেতে চায় না । দিশি মদ তাঁর মুখে রোচে না । তাঁর চাই বিলিতি । চাই কোরা কাগজ ও লেখার সৌখিন সরঞ্জাম । দাম খুব চড়া হলে তবেই বাধ্য হয়ে কখনোসখনো দিশি ছোঁয়া । কে যেন একবার বললো , যে মদ খায় তার প্রার্থনা আল্লা শোনেন না । গালিব হেসে জবাব দেন , ভাই , যার মদ আছে সে আবার কীসের জন্য প্রার্থনা করবে ?

নগমা হ্যায় গমকোভি এ্যয়
দিল গনীমৎ জানিয়ে
বে সদা হো যায়েগা
ইয়ে সাজে হসতি একদিন ।
দুঃখনিঃসৃত গানে ধন্য
থেকো মন
অস্তির বাজনা হবে
একদা নীরব ।

দাগে ফেরাকে সোহবতে
শব কী জ্বলি হুয়ি
এক শমা রহ্ গয়ি হ্যায় তো
উয়ো ভি খামোশ হ্যায় ।
বিরহরাতের স্পর্শে
পুড়েছে অনেক
তার অবশিষ্ট বাতি
সেও চুপচাপ ।
কবিদের কবি সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত গালিবের কবিতার
মূল অন্তর্বস্তু কিন্তু শিরা ছেঁড়া রক্তপাত ।

গালিবের সাত সন্তান একের পর এক মারা যায় । নিজের সন্তান বাঁচছে না দেখে ভাগ্নে মীরজা জয়নুল আবেদিনকে পোষ্য নেন । সে ছিল কবির খুব প্রিয় । সেও কবিতা লিখতো । কিন্তু সেও তরুণ বয়সেই মারা যায় । তার অকাল মৃত্যুতে গালিব যে শোকগাথা লেখেন তা উর্দু কাব্যের অন্যতম সেরা শোককবিতা । ধ্রুপদী সংযম , অসামান্য পরিমিতিবোধ এবং শোকদুঃখকে হেলায় উড়িয়ে দিতে গিয়ে তাকে আরও তীব্র ও মর্মস্পর্শী করে তোলা ছিল এই মরমী কবির অতি লক্ষনীয় বৈশিষ্ট ।
লাজিম থা কে দেখো মেরা রাস্তা কোইদিন অওর
তনহা গয়ে হো অব রহো তনহা কয়ী দিন অওর ।
তোমার উচিত ছিল আরও কিছুদিন আমার জন্য
অপেক্ষা করা
এখন যখন একা আছো
কিছুদিন একাই থাকো ।

ব্যক্তিগত , সামাজিক ও সাংসারিক দুর্বিপাক কবিকে কখনোই কাবু করতে পারে নি । তিনি থাকতেন হাসি ও কৌতুকে সদা ঝলমল । আত্মপীড়নেও হেসে উঠেছেন । কবিতায় এঁকেছেন রহস্যরসে ভরা অনাবিল সৌন্দর্য । নিজেকে নিয়েও নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ বিদ্রুপে মেতে উঠতেন সততই ।
মাত্র ২৩৪ টি গীতিকবিতা সম্বল করে উর্দু কাব্যের অধীশ্বর হয়ে রইলেন গালিব ।

নাদান হো যো কহতে হো
কিউঁ জিতে হো গালিব
মুঝকো তো হ্যায়
মরনে কি তমান্না
কোই দিন অওর ।

মৃত্যুর বাসনা নিয়ে আরো কটা দিন বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাই গালিবের লেখার প্রেরণা ।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলা হয় ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে আদালতে । আর সবচেয়ে বেশি সত্য বলা হয় মদ ছুঁয়ে পানশালায় । এই ছিল গালিবের চরম ও পরম উপলব্ধি । আরও লিখলেন :
জীবন বড়োই বিচিত্র । সন্ধ্যা কাটতে চায় না , অথচ দিব্যি কেটে যাচ্ছে বছর । সন্ধ্যা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সেই পাখিকে জিজ্ঞাসা করো যার কোনো ঘর নেই ।

জিন্দেগী ইউঁ ভি গুজর
হি যাতি
কিউঁ তেরা রাহ্ গুজর
ইয়াদ আয়া?
তোমার পথের কথা মনে না পড়লেও জীবন যখন সহজেই কেটে যাচ্ছিল তখন কেনই বা ওসব মনে পড়া ?

কতা কিজিয়ে নহ্ তঅল্লুক হমসে
কুছ নহীঁ হ্যায় তো
অদাবৎ হি সহী ।
সব সম্পর্ক ছিন্ন কোরো না
আর যদি কিছু না থাকে
শত্রুতাই থাক ।
হ্যায় আদমি বজায়ে খুদ
এক মেহশরে খয়াল
হম আঞ্জুমান সমঝতে হ্যায়
খেলওয়াৎ হি কিউঁ না হো ।
মানুষ নিজেই সহায়হীন
ভাবনার এক প্রচন্ড ভীড়
একলা হয়ে রইলে বসে
সম্মেলনে থেকেও ।
মানুষ একা কাঁদে , সংঘে কি কাঁদে না ? এই প্রশ্ন রেখে গেছেন আমাদের বাংলা কাব্যের শক্তি কবি । তিনি যে তাঁর বন্ধু আয়ান রশীদের সঙ্গে জুটি বেঁধে গালিবের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে গেছেন ।
নিজের সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা গালিব ধর্মগ্রন্থের অসারতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই লিখে গেছেন : মানুষ যদি হতে চাও তাহলে চিকিৎসা বিদ্যা , জ্যোতির্বিজ্ঞান , পদার্থবিদ্যা , তর্ক ও দর্শনশাস্ত্র পড়ো ।

দর্শন গালিব জানতেন কবিতার পরিবর্ত নয় , তবুও বড়ো কবিতা সবসময় ভাবনার খোরাক জোগায় মানতেন । তাঁর নিজের আজব মনটা সবসময় নিজেকে প্রশ্ন করে বেড়াতো । যদিও বিশেষ কোনো তত্ত্ব , চিন্তাধারা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো দার্শনিক ভাবধারায় ‌তিনি জব্দ ছিলেন না , তবুও তাঁর কবিতা কখনো ‌কখনো দর্শনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে মানুষকে গভীর চিন্তার খোরাক জোগায় । আজীবন দুঃখী ও বিরহীদের পক্ষে থাকা এই মানবিক কবির প্রেমতৃষ্ণা জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়েও ফুরোয় নি ।

ইশক্ সে তবিয়ৎ নে জিস্ত
কা মজা পায়া
দর্দকা দাওয়া পায়ি
দর্দে লাদওয়া পায়া ।
প্রেম থেকে পাই বাঁচার মজা
সেই মজা সব ব্যথার ওষুধ
প্রেমটি নিজেই এমন ব্যথা
তার কখনো হয় না ওষুধ ।

আরও পড়ুন- মাসল্ মেমরি, এক সাধনা, উৎপল সিনহার কলম

Previous articleটলিউডের বড় তারকারাও জড়িয়ে, সব প্রকাশ্যে আসবে! বি*স্ফোরক বনির মা
Next articleলালবাজারের বহুতলে আ*গুন! এলাকায় আ*তঙ্ক