‘এসো তৃষ্ণার জল’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

এসো এসো হে তৃষ্ণার জল,
কলকল্ ছলছল্ —
ভেদ করো কঠিনের
ক্রুর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্ ।।
এসো এসো উৎসস্রোতে
গূঢ় অন্ধকার হতে
এসো হে নির্মল কলকল্ ছলছল্ ।।

বিশ্বের তিনভাগ জল ও একভাগ স্থল হলেও ভবিষ্যতে ‘ পেয় ‘ জলের অভাব দেখা দিতে পারে যে কোনো সময় । জলই জীবন । অথচ জলের অভাবে গলা শুকোবে মানবসভ্যতার , এ বড়ো ভয়ঙ্কর আশঙ্কা । পরিচ্ছন্ন জল ও জলসম্পদ সংরক্ষণ সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলার ভাবনা থেকেই ‘ বিশ্ব জল দিবস ‘ পালনের সিদ্ধান্ত । ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভা ২২ মার্চ দিনটিকে বিশ্ব জল দিবস হিসেবে ঘোষণা করে । ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের এজেন্ডা ২১-এ প্রথম বিশ্ব জল দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয় এবং তারপর থেকে এই দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে । জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলি এই দিনটিকে নিজ নিজ রাষ্ট্রসীমার মধ্যে জাতিসংঘের জলসম্পদ সংক্রান্ত সুপারিশ ও উন্নয়ন প্রস্তাবগুলির প্রতি মনোনিবেশের দিন হিসেবে উৎসর্গ করে । এর পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও পরিচ্ছন্ন জল ও জলসম্পদ রক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য এই দিনে বিশেষ কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে ।

একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে মানুষ প্রায় সবসময়ই খাবার জলের অপচয় করে চলে । বাসন মাজা , কাপড় কাচা , স্নান ইত্যাদি সব কাজেই অপচয় হয় খাবার জলের । মানুষের সেটা মনে থাকে না । মনে রাখতে হবে শুধু ভারত নয় , সারা পৃথিবীতেই ভূগর্ভস্থ জলস্তর নামছে তো নামছেই । বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করে ভারত । দেখা যাচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের উচ্চতা কমেছে ভয়াবহভাবে , প্রতি বছরে ১০ থেকে ২৫ মিমি । গড়ে কমেছে ৫৪ শতাংশ । চাষ আবাদের ক্ষেত্রেও ভারতে যে জল ব্যবহৃত হয় তার ৭০ শতাংশের উৎস হলো ভূগর্ভস্থ জল । তথ্য বলছে , যদি এইভাবে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের উচ্চতা কমতে থাকে তাহলে ভারতের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের জন্য পানীয় জলের গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে । ইতিমধ্যেই পাতকুয়ো , কুয়ো শুকোতে শুরু করেছে । মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করার বিপদ এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে । পুকুর , খাল , বিল ও নদীর অবস্থাও খারাপ । গুণগত মানের দিক থেকেও দেখা গেছে , ভূগর্ভস্থ জলের অবস্থা মোটেও ভালো নয় । পানীয় জলের সঙ্কট ইতিমধ্যেই গ্রীষ্মের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে । কান্ডজ্ঞানহীনের মতো ভূগর্ভস্থ জল পাম্প করে তোলা আটকাতেই হবে । প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে । ইউক্যালিপটাসের মতো গাছ , যেগুলি ভীষণ পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল শুষে নেয় , এরকম গাছ লাগানো চলবে না । জমিতে কেমিক্যাল ব্যবহার করাও আটকাতে হবে । ভূপৃষ্ঠের মাত্র ৩ শতাংশ জল পানযোগ্য অর্থাৎ পেয় । বাকি ৯৭ শতাংশ সমুদ্রে । মিঠা জলের মধ্যে ৬৯ শতাংশ হিমবাহ অবস্থায় , ৩০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ এবং ১ শতাংশের কম হ্রদ , নদী এবং জলাভূমিতে অবস্থিত ।

দূষিত জল ও দুর্বল স্যানিটেশন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি । সঠিক জল , স্যানিটেশন এবং হাইজিন ( ওয়াশ ) ছাড়া শিশুদের রোগের ঝুঁকি থেকেই যায় । পরিশুদ্ধ জল ছাড়া সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা অসম্ভব । বিশুদ্ধ জল বিশ্বের প্রথম ও প্রধান ওষুধ , এই কথাটি সর্বৈব সত্য । আমাদের জীবনের সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান জল । জল প্রকৃত অর্থেই অত্যাবশ্যক সম্পদ । এই সম্পদকে তাই রক্ষা করতেই হবে । প্রতি বছর IGRAC দ্বারা একটি করে ‘ থিম ‘ জল সংক্রান্ত বিষয়বস্তু গ্রহণ করা হয় ।

জাতিসংঘের পরিকল্পনা অনুসারে , জল দিবসের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য পরিশুদ্ধ পানীয় জল ও উপযুক্ত স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা করা ।‌ বিশ্ব উষ্ণায়ন , জলবায়ুর পরিবর্তন , পানীয় জলের অপব্যয় ইত্যাদি নানা কারণে ক্রমশ কমছে বিশুদ্ধ জলের পরিমাণ তথা মাত্রা । জল রক্ষা করতে নেওয়া হচ্ছে নানান উদ্যোগ । তীব্র জল সঙ্কটে যাতে মানব সভ্যতাকে পড়তে না হয় , সেই ভাবনা থেকেই বিশ্ব জল দিবস উদযাপন । এই দিনের মূল উপজীব্য valuing water , জলের মূল্যায়ন । আমাদের দেশে বিভিন্ন ভাষায় স্লোগান দেওয়া হয় : জল ধরো জল ভরো , জল বাঁচাও প্রাণ বাঁচাও ।
কবি বিষ্ণু দে লিখেছেন :
… জল দাও আমার শিকড়ে ।
বিনয় মজুমদার লিখেছেন :
ডুব দিয়ে দেখে আসি
নধর জলের নিচে
এখনো রয়েছে কিনা
কোনো অবশেষ ।

মনে রাখতে হবে জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে ২.২ বিলিয়নের বেশি মানুষ নিরাপদ জলের সুবিধা ছাড়াই জীবন কাটান । এও মনে রাখতে হবে যে বাস্তুতন্ত্রের প্রতি অবহেলা করা প্রায় অপরাধের সামিল । জল মূল্যবান সম্পদ , বিষয়টি শুধুমাত্র জলের মূল্য নিয়ে নয় , তার চেয়ে অনেক বেশি । বিষয়টি পরিবার , খাদ্য , শিক্ষা , স্বাস্থ্য , সংস্কৃতি , অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্রে জলের অবদানের সঙ্গে সম্পর্কিত । তাই জলসম্পদ সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রচারাভিযানের ভীষণ গুরুত্ব রয়েছে এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে ।

আমাদের দেশে সমস্ত জল ব্যবহারকারীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কেন্দ্রিয় জল কমিশন । রাষ্ট্রের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা ব্যবহার ক’রে ভারতের জলসম্পদের সমন্বয় , উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার কাজ করে তারা । ২০২৩ সালের বিশ্ব জল দিবসের থিম হলো , ‘ পরিবর্তন তরান্বিত করতে আমাদের আরও পদক্ষেপের প্রয়োজন । ‘

জল ও স্যানিটেশন সঙ্কটের সমাধানে পরিবর্তনকে তরান্বিত করার তাৎপর্য সকলকে বুঝতে হবে । তরল স্বাদু পানীয় জলকে যে কোনো মূল্যে সংরক্ষণ করতে হবে মানবসভ্যতাকে দীর্ঘায়িত করার আশু লক্ষ্যে এবং একই সঙ্গে পানীয় জলের অপব্যয় বন্ধ করতেই হবে ।

আরও পড়ুন- বাড়ছে ডিগ্ৰি কোর্সের সময়সীমা! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নয়া নির্দেশ রাজ্যের

Previous articleশহরে বিশেষ শিল্পমেলা নিয়ে উৎসাহ তুঙ্গে 
Next articleটলিপাড়ায় অ*গ্নিকাণ্ড, পু*ড়ে ছা.ই স্টুডিয়োর একাংশ