‘বেনিফিট অফ ডাউট’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

ব্যাট করছেন বিরাট কোহলি ।

বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদি ।
জমে উঠেছে ব্যাট বলের লড়াই । কখনো মনে হচ্ছে এই বুঝি আউট হয়ে গেলেন বিরাট । আবার পরের বলেই গ্যালারিতে আছড়ে ফেলছেন বল । টানটান উপভোগ্য ম্যাচ । দর্শকদের তুমুল গর্জন আর ক্ষণিকের স্তব্ধতা জানান দিচ্ছে চরম অনিশ্চয়তার ক্রিকেট তার উৎকর্ষতার সর্বোচ্চ শিখরে বিরাজমান ।
‘ স্টপার ‘ , ‘ স্ট্রাইকার ‘ ও
‘ কোনি ‘ খ্যাত মতি নন্দী বলেছিলেন , ‘ নেভিল কার্ডাস একজনই হন , তাঁর কোনো বিকল্প হয় না । জীবনের শেষ ইনিংসে স্যার ডন ব্রাডম্যানের শূন্য রানে আউট হওয়া নিয়ে নেভিল কার্ডাস যা লিখে গেছেন , তা আর কারও পক্ষে লেখা অসম্ভব । ‘
স্যার ডন ছুঁয়ে আবার ফেরা যাক বিরাট-শাহিনে ।
একি ! বিরাট আউট নাকি ?

মাঠের দুই আম্পায়ার তৃতীয় আম্পায়ারের শরণাপন্ন হয়েছেন । কিন্তু টিভি রিপ্লেও ঠিকঠাক দেখাতে পারছে না বিরাট আউট কিনা । আসলে শাহিনের একটি বিদ্যুৎগতির বল অফস্ট্যাম্পে প’ড়ে আরও বাইরের দিকে যাওয়ার মুখে বিরাট ব্যাট চালিয়েছেন সজোরে । ডিপ মিড অফের ফিল্ডার অনেকটা পিছিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাউন্ডারি লাইনের কাছাকাছি । বিরাটের লফটেড শট অনেকটা ছুটে এসে ক্যাচ ধরেছেন সেই ফিল্ডার । কিন্তু বল সেই ফিল্ডারের তালুবন্দি হবার আগে মাটি ছুঁয়েছে কিনা ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না । বারবার রিপ্লে দেখানোর পরেও কিছুতেই নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে না যে ক্যাচটা একশো শতাংশ নির্ভুল কিনা ।

আউটের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে আম্পায়ার আউট দেবেন কি করে ? এই অবস্থায় আম্পায়ার বিরাটকে দিলেন ‘ বেনিফিট অফ ডাউট ‘ । অর্থাৎ সন্দেহাতীতভাবে আউট নয় বিরাট । অকাট্য প্রমাণ ছাড়া কোনো অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়ার মতো অবিচার আর নেই । এখন প্রশ্ন হতে পারে , এই বেনিফিট অফ ডাউটের সুবিধা বোলার আফ্রিদি কেন পেলেন না । পেলেন না , কারণ একজন বোলার তো আরও অনেক বল করবেন । ব্যাটসম্যানকে আউট করার আরও অনেক সুযোগ পাবেন । কিন্তু ব্যাটসম্যান একবার আউট হয়ে গেলে ব্যাট করার আর দ্বিতীয় সুযোগ পাবেন না । মূলত ক্রিকেটের পরিভাষা হিসেবে এই শব্দবন্ধটি অধিক প্রচলিত হলেও আইন তথা বিচার ব্যবস্থায় , এমনকি মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও এই বেনিফিট অফ ডাউটের গুরুত্ব অপরিসীম । সন্দেহের সুবিধা । সন্দেহাবসর । সন্দেহাবকাশ । সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বেনিফিট অফ ডাউট দেওয়া হয়ে থাকে । ক্রিকেট ম্যাচে প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্নিকো , আল্ট্রা এজ , হটস্পট , স্পিন ভিশনের মাধ্যমে অনেক সময়ই সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেলেও মাঠে এমন এমন আশ্চর্য ঘটনা ঘটে , যা আম্পায়ারদের একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয় , বিশেষত ব্যাটসম্যানের আউট নিয়ে যখন সন্দেহ দেখা দেয় । কখনো কখনো দেখা যায় বল খুব কাছাকাছি সময়ে ব্যাট ও প্যাড দুটোকেই স্পর্শ করেছে একসাথে । এসব ক্ষেত্রে স্থির ও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে আম্পায়ারদের পক্ষে । সবচেয়ে অসুবিধা হয় স্ট্যাম্পিং ও রান আউটের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ।

 

মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও ছোট বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রায়ই মানুষকে এই বেনিফিট অফ ডাউটের শরণাপন্ন হতে হয় । কারো সম্পর্কে খারাপ এবং ভালো , এই দুই ধরনের ধারণা করে নেওয়ার অধিকার সকলেরই আছে । তবু কোনো একজন মানুষের সম্পর্ক আগাম খারাপটা না ভেবে যদি তাকে প্রাথমিকভাবে ভালমানুষ হিসেবে ধরে নেওয়া হয় , সেও তো একধরনের বেনিফিট অফ ডাউট । পারস্পরিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বেনিফিট অফ ডাউট প্রায় অপরিহার্য।

দোকানে ক্রেতার কোনো একটি দ্রব্য পছন্দ হয়েছে অথচ সেটি কেনার মতো পর্যাপ্ত পয়সা পকেটে নেই যা দিয়ে তৎক্ষণাৎ জিনিসটি কেনা যেতে পারে , এই অবস্থায় দোকানী ‘ অন গুড ফেথ ‘ অচেনা ক্রেতাটিকে বেশ কিছু টাকা বাকি রেখে জিনিসটি দিয়ে দিলেন । এজন্যই দিলেন যে ক্রেতার কথাবার্তায় ও ব্যবহারে তাঁর মনে হলো এই মানুষটিকে বিশ্বাস করা যায় । এখানে ক্রেতা পেলেন বেনিফিট অফ ডাউট ।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই বেনিফিট অফ ডাউটের চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ঠগ , জোচ্চোর , প্রতারক ও ধর্ষক সহ বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের অপরাধীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । অপরাধীদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ এই বেনিফিট অফ ডাউট । তারা জানে এর বিপুল সুবিধা । ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ-এর মাঝে চিনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেনিফিট অফ ডাউট ।

ভাবা যায় না , হয় ফাঁসি নয় বেকসুর খালাস ! নিশ্চিত প্রমাণের অভাব , তাই সন্দেহের সুবিধা পায় অভিযুক্ত । সন্দেহের এই সুবিধা পেয়ে যুগে যুগে মুক্তি পেয়েছে এবং এখনও পায় ভয়ঙ্কর অপরাধীরা । আবার ভুয়ো প্রমাণের সাঁড়াশি আক্রমণে সন্দেহের সুবিধা না পেয়ে কতো নিরপরাধ যে কঠোর দণ্ড ভোগ করে তার ইয়ত্বা নেই । ‘ প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে , বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে ‘ ।

জীবন ও মৃত্যুর মাঝে সূচ্যগ্র মাত্র ব্যবধানের মতো, বিচার ও অবিচারের মাঝে তিল পরিমাণ দুরত্বই পাহাড়সদৃশ হয়ে দেখা দেয় বেনিফিট অফ ডাউটের সুবিধা পাওয়া ও না পাওয়া মানুষগুলোর কাছে । এ খেলা চলছে নিরন্তর । অপরাধীরা নিপাত যাক ।

সত্যের জয় হোক । জীবনদায়ী বেনিফিট অফ ডাউট কেবল সততার পক্ষে সওয়াল করুক । মৃত্যু হোক মিথ্যার ।

আরও পড়ুন- ৩ শিশুর পর টানা বৃষ্টিতে বাঁকুড়ায় ফের মাটির দেওয়াল ধসে মৃ*ত্যু বৃদ্ধার

 

 

Previous articleবিশ্বকাপ দলে অক্ষরের জায়গায় অশ্বিন, খুশি নন যুবরাজ
Next articleবালুচিস্তানের জোড়া বিস্ফো.রণে যোগ রয়েছে ভারতের গু.প্তচর সংস্থার! দাবি পাকিস্তানের