মহালয়া দিনটি কি আদৌ শুভ? শাস্ত্র কী বলছে? কেন করবেন তর্পণ?

হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ফেসবুক ও ট্যুইটারে 'শুভ মহালয়া' বার্তার জোয়ার। কিন্তু দিনটি কি আদৌ শুভ? শাস্ত্র কী বলছে? 

কাক ডাকা ভোরের আলোয় এক দিকে রেডিওয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ,অন্য দিকে গঙ্গার ঘাটে তর্পণ। বাঙালি মাত্রেই চোখ বন্ধ করে বলে দেবেন,দিনটি মহালয়া। পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ফেসবুক ও ট্যুইটারে ‘শুভ মহালয়া’ বার্তার জোয়ার। কিন্তু দিনটি কি আদৌ শুভ? শাস্ত্র কী বলছে?

মহালয়ার ভোরে চণ্ডীপাঠ ও মহিষাসুরমর্দিনীর সুর ভেসে আসা মানেই দুর্গাপুজো শুরু। এখন তো প্রায় সব বড় পুজোর উদ্বোধন হয়ে যায় মহালয়ার আগেই। কিন্তু এই শুভ অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রয়াত পিতৃপুরুষের তর্পণ কেন জড়িয়ে সে প্রশ্ন অনেকের মনে উঠতে পারে। পণ্ডিতদের অনেকের মতে তর্পণ এবং পার্বণ শ্রাদ্ধের প্রশস্ত দিন হিসেবে মহালয়া পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের তিথি বলে নির্দিষ্ট হওয়ায় একে ‘শুভ’ বলে গ্রাহ্য না করাই ভালো।

তবে অনেকের মতে মহালয়া কথাটি এসেছে ‘মহত্‍ আলয়’ থেকে। হিন্দু ধর্মে মনে করা হয় যে পিতৃপুরুষেরা এই সময়ে পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন জল ও পিণ্ডলাভের আশায়। প্রয়াত পিতৃপুরুষদের জল-পিণ্ড প্রদান করে তাঁদের ‘তৃপ্ত’ করা হয় বলেই মহালয়া একটি পূণ্য তিথি।

এই সূত্রেই পণ্ডিত সতীনাথ পঞ্চতীর্থ বলেছেন, ‘মহালয়ায় যে তর্পণ করা হয়, তা শুধুই পিতৃপুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেব তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্য-পিতৃ তর্পণ করতে হয়। সঙ্গে থাকে রাম তর্পণ ও লক্ষ্মণ তর্পণ। সেখানে ত্রিভুবনে সমস্ত প্রয়াতকে জলদানের মাধ্যমে তৃপ্ত করার কথা বলা আছে। এমনকী তাঁদেরও উদ্দেশে তর্পণ করা হয়, জন্ম-জন্মান্তরে যাঁদের আত্মীয়-বন্ধু কেউ কোথাও নেই। এই ভাবে যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত সকল প্রয়াতকে জলদান করে তাঁদের আত্মার তৃপ্তি সাধন করা হয়, তাহলে সেই দিনকে অশুভ বলে ভাবা হবে কেন?

কিন্তু নিশ্চয়ই ভাবছেন কী ভাবে শুরু হল তর্পণ প্রথা? এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। রামায়ণ অনুসারে ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র অসময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য। শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজো বসন্তকালে হওয়াই নিয়ম। শ্রীরামচন্দ্র অকালে দুর্গাপুজো করেছিলেন বলে একে অকাল বোধন বলা হয়। সনাতন ধর্মে কোনও শুভ কাজের আগে প্রয়াত পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। লঙ্কা বিজয়ের আগে এমনটাই করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সেই থেকে মহালয়ায় তর্পণ অনুষ্ঠানের প্রথা প্রচলিত।

আবার মহাভারত অনুযায়ী, মৃত্যুর পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। দেবরাজ ইন্দ্রকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেন নি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।

সনাতন ধর্ম অনুযায়ী এই দিনে শুধু পিতৃপুরুষ নন, জাতি-ধর্ম-ভাষানির্বিশেষে জগৎ সংসারের সকলকে তর্পণ করা যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী, চেনাজানার বাইরেও সকলকে তর্পণ করা যায় এই দিনে। ফলে এই দিনটি মহৎ যার সঙ্গে মহালয়া শব্দটির সুস্পষ্ট যোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত,তর্পণ একধরনের তৃপ্তি দেয়। যিনি তর্পণ করছেন, তিনিও তৃপ্ত হন। আর তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী, যাঁদের উদ্দেশে তর্পণ, সেই পূর্বপুরুষদের আত্মারাও তৃপ্তি পান। আর তৃপ্তি একটি এমন মানবিক বৃত্তি যা ইতিবাচকতা তৈরি করে। ফলে এর মধ্যে কোনও অশুভ কিছু নেই।’
মোদ্দা কথা, আগমনী সুর, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের চণ্ডীপাঠ,গঙ্গার ঘাটে তর্পণ, বিশ্বাস, এমনকী অবিশ্বাস–সবটা নিয়েই ‘শুভ’ মহালয়া,বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

Previous articleনিয়োগ মামলার ত.দন্তে পার্থকে জেলে গিয়ে ফের জেরা করল সিবিআই
Next articleমহালয়ার সকালে তর্পনের ভিড়, ঘাটে ঘাটে ক.ড়া নিরাপত্তা