‘বড় একা লাগে’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

স্যাটা বোসকে মনে আছে ? ঝকঝকে , স্মার্ট , ইংরেজ আদব- কায়দা অনুশীলনে সর্বদা তৎপর সেই বোহেমিয়ান বাঙালি , যাঁর আসল নাম সত্যসুন্দর বসু , মনে পড়লো ? বাঙালির পক্ষে স্যাটা বোসকে ভোলা বড় সহজ নয় । কারণ স্যাটা বোসের কথা ভাবলেই অবধারিতভাবে একটা গান এসে দাঁড়ায় স্মৃতির সরণিতে।

সেই যে ,
বড় একা লাগে এই আঁধারে
মেঘের খেলা আকাশ পারে …
( কণ্ঠ : মান্না দে , অভিনয় : উত্তমকুমার )

এটি ‘ চৌরঙ্গী ‘ ছায়াছবির গান । দারুণ জনপ্রিয় । মণি শংকর মুখোপাধ্যায়ের ( শংকর ) উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল ১৯৬৮ সালে । ছবির পরিচালক পিনাকী ভূষণ মুখোপাধ্যায় । সুরকার তথা সঙ্গীত পরিচালক অসীমা মুখোপাধ্যায় । স্যাটা বোসের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন উত্তমকুমার । তাঁর বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন অঞ্জনা ভৌমিক । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , এই ছবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিন ব্যক্তিত্ব গত ফেব্রুয়ারিতে একে একে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আশ্চর্য সমাপতন।

১৭ ফেব্রুয়ারি , ১৯২৪ চলে যান অঞ্জনা ভৌমিক । ২০ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেন অসীমা মুখোপাধ্যায় । আর ২৯ ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন মিল্টু ঘোষ , ‘ বড় একা লাগে ‘ গানের স্রষ্টা । মৃত্যুকালে গীতিকারের বয়স হয়েছিল প্রায় ৯০ ।

মিল্টু ঘোষের লেখা গান ‘ এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে ‘ ছাড়া আজও বাঙালির লক্ষ্মীপূজা সম্পূর্ণ হয় না । এঁর লেখা জনপ্রিয় গানের তালিকা বেশ দীর্ঘ । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘ ও আকাশ সোনা সোনা ‘ এবং ‘ জীবনের অনেকটা পথ ‘ বাঙালি শ্রোতাদের দারুণ পছন্দের । এছাড়াও ‘ কাজল কাজল কুমকুম ‘ ( গীতা দত্ত ) , ‘ মন্দ বলে লোকে ‘ ( মুকেশ ) আজও মানুষের স্মৃতিতে অমলিন ।

ছোটবেলায় দারুণ ফুটবল খেলতেন মিল্টু । কবিতাও লিখতেন খুব । যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা মিল্টু যে গীতিকার হিসেবে একদিন স্বনামধন্য হয়ে উঠবেন তা তিনি নিজেও কোনদিন ভাবেন নি । কোনো একটি অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত সুরকার সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর । বেশ কয়েকটি গান তাঁর হাতে তুলে দেন মিল্টু । তার মধ্যে ‘ কাজল কাজল কুমকুম’ পছন্দ হয়ে যায় সুরকারের । ব্যস , আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি মিল্টুকে। রাজ্য সরকারের পরিবহন দপ্তরের কর্মী মিল্টু ঘোষ দীর্ঘ চার দশক ধরে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন , তারপর একসময় হঠাৎই অন্তরালে চলে যান । অভিমান অথবা যে কোনো কারণেই হোক , নতুন করে আর যোগাযোগ করেন নি গানের জগতের সঙ্গে ।‌ ছায়াছবির জন্য গান লেখা ছিল তাঁর অন্যতম প্যাশন । তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘ তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে ‘ আজও গেঁথে আছে বাঙালি শ্রোতাদের মনে । তাঁর লেখা ‘ ওগো বন্ধু আমার ‘ কে ভুলতে পারে ?

মিল্টুরা ছিলেন চার ভাই ও দুই বোন । কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশোনা করা মিল্টু ১৯৬৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শুভ্রাদেবীর সঙ্গে । ‘ এক তাজমহল গ’ড়ো হৃদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলে ‘ মিল্টুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃজন ।

আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও গুনগুন করে এই গান । সুরকার নচিকেতা ঘোষ । এই গান অমরত্ব লাভ করেছে প্রেমের গান হিসেবে । গেয়েছেন পিন্টু ভট্টাচার্য । ‘ জানি না কখন সে যে কিছুকিছু পিছুটান রেখে গেছে ‘ গানটিও পিন্টু ভট্টাচার্যের গাওয়া । সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায় । এ প্রসঙ্গে পিন্টু ভট্টাচার্য ও অনল চট্টোপাধ্যায়ের যৌথতায় তৈরি মিল্টুর আরেকটি গান ‘ ফিরে যেতে চাই যেতে চাই ‘ উল্লেখ্য ।

বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী অপরেশ লাহিড়ীর বাড়িতে গুণীজনদের আড্ডায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল মিল্টুর । সেখান থেকে অনেক শিখেছিলেন তিনি । মৃণাল চক্রবর্তীর সুরে ও কণ্ঠে থেকে গেছে মিল্টুর স্মৃতিমেদুর গান ‘ কেন জানি না যে শুধু তোমার কথাই মনে পড়ে ‘ । ‘ ও ময়না রে এই গয়না রে আর সয়না রে ‘ মিল্টুর আরেকটি অতি জনপ্রিয় সৃষ্টি ( কণ্ঠ : মুকেশ , সুর : ভি বালসারা ) ।

‘ প্রথম প্রেম ‘ নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্রে মিল্টু ঘোষ প্রথমবারের মতো ছায়াছবির জন্য গান লেখার সুযোগ পান। সেই ছবিতে অভিনয় করেন ফুটবলার চুনী গোস্বামী। গতবছর ‘ এসো মা লক্ষ্মী ‘ গানের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে । এই গান ব্যবহৃত হয়েছিল ‘ দাবি ‘ ছবিতে । গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় । সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায় ।

মিল্টু ঘোষ থাকতেন বরানগরে মতিলাল মল্লিক লেনে । ‘ টগবগ টগবগ ঘোড়া ছুটিয়ে ‘ দীর্ঘ চার দশকের সঙ্গীত-সফর যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ । বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অন্যতম সেরা গীতিকার মিল্টু ঘোষ বাংলা গানের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন । তাঁর ভাণ্ডারে রয়ে গেছে বেশ কিছু অবিস্মরণীয় গান । শুধু প্রেম , বিরহ আর চাঁদ-ফুল-জোছনা নয় , মানুষের জীবনের প্রতিটি মূল্যবান অনুভূতি ও উপলব্ধিকে ভাষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে । লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন মানুষের জীবন সংগ্রাম । তাই মানুষ তাঁকে আজও ভোলে নি ।

আরও পড়ুন- ফরওয়ার্ড ব্লকের আপত্তিতেই চিড় বাম-আইএসএফের জোটে! নওশাদদের হাত ছাড়ল আলিমুদ্দিন

Previous articleফরওয়ার্ড ব্লকের আপত্তিতেই চিড় বাম-আইএসএফের জোটে! নওশাদদের হাত ছাড়ল আলিমুদ্দিন
Next articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ