সোমবার দেশে লাগু হল নয়া ফৌজদারী আইন! সমালোচনায় সরব তৃণমূল

সোমবার থেকে গোটা দেশে কার্যকর হওয়া নতুন তিনটি ফৌজদারি আইনের তীব্র বিরোধিতা করল তৃণমূল কংগ্রেস। একের পর এক যুক্তি এবং তথ্য দিয়ে প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ জহর সরকার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নিদারুণ ব্যর্থতা। অপরাধ সংক্রান্ত ৩টি নতুন আইন কেন্দ্র এদিন দেশজুড়ে লাগু করায় সোমবার ১ জুলাই দিনটিকে কালাদিবস হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। বাংলার প্রতি বিজেপি এবং কেন্দ্রের প্রতিহিংসা, বঞ্চনা- প্রতিটি বিষয়ই উঠে এল তাঁর ভাষণে। একইসঙ্গে নারী ক্ষমতায়ণের প্রশ্নে বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রশংসনীয় ভূমিকার কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন রাজ্যসভার সাংসদ জহর সরকার। রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপরে সংসদে তৃণমূলের সমালোচনার এদিন সূচনা করলেন জহর সরকারই।

১জুলাই দিনটিকে কেন কালাদিবস হিসেবে অভিহিত করলেন তৃণমূল সাংসদ? তাঁর যুক্তি, সংসদে ৩টি নতুন বিল আইনে পরিণত করার দিন অগণতান্ত্রিকভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছিল ১৪৬ জন সাংসদকে। কার্যত বিরোধীশূন্য অধিবেশনেই লোকসভায় পাশ করানো হয়েছিল এই আইন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল নতুন আইনে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই যে কাউকে গ্রেফতার এবং ৯০ দিন হেফাজতে রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এভাবেই সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে ক্ষমতা অপব্যবহারের। রাজনৈতিক কারণে অনশন, জমায়েত এবং প্রতিবাদেও নিষেধাজ্ঞা। ঘৃণাভাষণে কারাদণ্ডের কথা বলা থাকলেও মোদির মঙ্গলসূত্র এবং মুসলিম বিদ্বেষমূলক ভাষণ এর আওতায় আসবে কি?

বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ এবং বিদ্বেষমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা করেন প্রবীণ সাংসদ। জহরবাবুর অভিযোগ, অর্থনৈতিক অবরোধ করে বাংলার প্রতি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে কেন্দ্র। প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলার প্রাপ্য ১.৭২ লক্ষ কোটি টাকা কেন্দ্র আটকে রেখেছে কোন অধিকারে? কোন যুক্তিতে আটকে রেখেছে ১০০ দিনের টাকা, আবাসযোজনার টাকা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র সহ বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন খাতে পাওনা টাকা ? আসলে বাংলার মানুষ বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের রাজনীতি এবং মহিলাদের প্রতি দমননীতি কখনওই মেনে নিতে পারেন না বলে বাংলার প্রতি বিজেপির এই বিদ্বেষ।

তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মনে করিয়ে দেন বাংলা মহিলাদের বিশেষ সম্মান দেয়। তৃণমূল কংগ্রেসই একমাত্র দল যাদের রাজ্যসভা এবং লোকসভা্র সাংসদদের মধ্যে ৩৮ শতাংশই মহিলা। অন্য কোনও দলেরই এই রেকর্ড নেই।

আরও একটি যুক্তিসঙ্গত প্রসঙ্গ তুলেছেন জহর সরকার। রাষ্ট্রপতির ভাষণে গুরুত্ব পেয়েছে সুশাসন। কিন্তু বিশ্বব্যাঙ্কের তালিকায় এই নিরিখে ভারতের স্থান ৬৬। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশেরও নীচে। এই তো সুশাসনের নমুনা। জিডিপি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকেও একহাত নিয়েছেন তিনি। ২০২৪ এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জিডিপি ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তা ৪ ট্রিলিয়ন ডলারেও পৌঁছায়নি। দেখা যাচ্ছে, ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরিব হয়েছে আরও গরিব। টেলিকম আইনেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। সবমিলিয়ে রাজ্যসভায় মোদির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন জহর সরকার।

অন্যদিকে দলের রাজ্যসভার সদস্য সাগরিকা ঘোষ নতুন আইনের একাধিক বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে প্রকাশিত বার্তায় তৃণমূল সাংসদ বলেছেন, নতুন আইনগুলিতে বহু অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং নাগরিকদের জীবন ও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার বিশাল সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে সরকারকে। তিনি বলেছেন, রাজদ্রোহের অপরাধের ধারা পিছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করানোর সুযোগ রাখা হয়েছে, যা খুবই বিপজ্জনক। সন্ত্রাসবাদকে প্রথমবারের জন্য সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং এটি প্রতিদিনের ফৌজদারি অপরাধের একটি অংশ হিসেবে রাখাও অত্যন্ত বিপজ্জনক। সাগরিকা বলেন, একজন পুরুষের দ্বারা একজন মহিলাকে বিবাহের প্রতিশ্রুতির মধ্যে প্রতারণাকে একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যক্তির গোপনীয়তায় অনুপ্রবেশ করতে চলেছে রাষ্ট্র।

উল্লেখ্য, সোমবার থেকে যে নতুন আইন কার্যকর হল তাতে ১৮৬০ সালে তৈরি ‍‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ বা ভারতীয় দণ্ডবিধি বদলে হয়েছে ‍‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’, ফৌজদারি দণ্ডবিধি বদলে হয়েছে ‍‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে করা হয়েছে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম। ন্যায় সংহিতায় একদিকে বাদ পড়েছে ১৯টি পুরনো আইন আর অন্যদিকে যুক্ত হয়েছে ২০টি নয়া বিধি।

সোমবার নতুন ফৌজদারি আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল-সহ বিরোধীরা সরকারকে কড়া আক্রমণ করে। দুই কক্ষেই সাংসদদের বরখাস্ত করে কার্যত বিরোধীশূন্য সংসদে বলপূর্বক আইন পাশ করার অভিযোগ তোলেন তাঁরা। তৃণমূলের দাবি, আইনের প্রধান অংশগুলি ‍‘কাট, কপি এবং পেস্টের কারসাজি।’ গত ডিসেম্বরে সংসদে পাশ হওয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, এবং ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম বিরোধীদের বক্তব্য ও আপত্তি উপেক্ষা করে আইনে পরিণত করা হয়েছে। এত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পর্যাপ্ত আলোচনা ও বিতর্ক এড়িয়ে চরম অগণতান্ত্রিক কাজ করেছে মোদি সরকার। এই আইন নিয়ে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে বলেছেন, নির্বাচনে রাজনৈতিক এবং নৈতিক ধাক্কার পর মোদিজি এবং বিজেপি সংবিধানকে সম্মান করার ভান করছে, কিন্তু সত্য হল যে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার তিনটি আইন (যা সোমবার থেকে কার্যকর হচ্ছে), জোর করে ১৪৬ জন সাংসদকে বরখাস্ত করে পাশ করানো হয়েছিল। কংগ্রেস সাংসদ ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম এই প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞ এবং আইনজীবীদের সমালোচনার সমাধান না করার জন্য এবং সংসদে বিতর্ক না করায় সরকারকে তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান তিনটি আইনকে বুলডোজ করে পর্যাপ্ত আলোচনা ও বিতর্ক ছাড়াই তিনটি নতুন বিল দিয়ে প্রতিস্থাপন করার আরেকটি ঘটনা। যার প্রাথমিক প্রভাব ফৌজদারি বিচার প্রশাসনকে চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দেবে।

আরও পড়ুন- মানবিক মেয়র দেখল বাংলা! ক্যানসার আক্রান্ত বৃদ্ধা ও তাঁর মেয়ের সঙ্গে দেখা করে সাহায্যের আশ্বাস ফিরহাদের

 

Previous articleগাড়ির উপর ভেঙে পড়ল গাছ, ব্যাহত হরিশ মুখার্জি রোডের যান চলাচল
Next articleএবার তমলুক, চুরির অভিযোগে ২ মহিলা সহ শিশুকে বেধড়ক মার ক্ষিপ্ত জনতার!