‘অনন্য রাধুবাবু’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

সঙ্গীত না বুঝলে ‘ সঙ্গত ‘ হবে কী করে ? সবাই তো আর ‘ রাধুবাবু ‘ হয়ে জন্মান না । মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় কিংবা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যখন বাজাচ্ছেন তখন যেমন কথা বলাচ্ছেন তবলাকে , ঠিক তেমনি একটি ছোট্ট মেয়ে যখন ভয়ে ভয়ে গাইছে গান , তাকে দুরন্ত নদীতে ভাসমান নৌকোর সুদক্ষ মাঝির মতো নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছেন সাফল্যের তীরে । তাই বুঝি সঙ্গীতমহলে তাঁকে বলা হতো ‘ মিস্টার পারফেক্ট ‘ । আর তাঁর সঙ্গীতবোধ ? তা নিয়ে তো পাতার পর পাতা লেখা যায় । তাঁর বাজনা যে শুধু শিল্পসুষমামণ্ডিত এবং অসামান্য কারুকার্যে ভরপুর তাই নয় , তিনি অনন্য , তিনি স্বতন্ত্র , তাঁর বাজনা অভিনব ।

তাঁর তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রায় বিরল । গানের প্রথম কলিতেই যেন তিনি গোটা গানটার মেজাজ বুঝে যেতেন । তারপর গোটা গানটিতে তিনি যেন সারথি কৃষ্ণ । সঙ্গতকার হিসেবে তাঁকে পেলে ধন্য হতেন শিল্পীরা , হতেন পরম নিশ্চিন্ত। গানের মেজাজ বোঝার মতোই তাঁর নিজের মেজাজটা ছিল আসল রাজা ।শোনা যায় , সন্ন্যাসী রাজা ছায়াছবির জন্য যখন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন ,

‘ কাহারবা নয় দাদরা বাজাও উল্টোপাল্টা মারছো চাঁটি ,
রাধাকান্ত তুমি দেখছি
আসরটাকে করবে মাটি ‘ ,

তখন সেই গানে মান্না দে-র সঙ্গে তবলা বাজাতে রাজি হন নি তিনি । ‘ তিনি ‘ অর্থাৎ তবলার জাদুকর রাধাকান্ত নন্দী । অগত্যা গানের কথা সামান্য বদলাতে বাধ্য হন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন । ‘ রাধাকান্ত ‘ নামের বদলে লিখতে হয় ‘ শশীকান্ত ‘ । এমনই আপসহীন ছিলেন এই আত্মদর্পী তবলা-শিল্পী ।

রাধাকান্ত নন্দী ( ১৯২৮ — ১৯৮৪ ) বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় কলকাতায় । রাধুবাবু নিজেও গান গাইতেন চমৎকার । অনামী অখ্যাত শিল্পীদের সাহস জুগিয়ে উদ্বুদ্ধ করার বিশেষ ক্ষমতা ছিল তাঁর । শুধু সঙ্গত নয় , একক বাদনেও তাঁর নৈপুণ্য ছিল প্রশ্নাতীত ।
তাঁর প্রাণপ্রিয় তবলা নিয়ে তিনি লিখে গেছেন :
‘ তবলা আমায় বাজায়
তাইতো আমি বাজি ,
তবলাকে মোর দুঃখ দিয়ে
বাজাতে নই রাজি ‘ ।

তাঁর বাবা রোহিনীকান্ত ছিলেন সে কালের খ্যাতিমান তবলিয়া । পিতামহ কালীচরণ ছিলেন কীর্তনীয়া ।ছোটবেলায় গ্রাম পরিক্রমায় নগরকীর্তনে রাধাকান্ত বাজাতেন শ্রীখোল । মাত্র ছ’ বছর বয়সে শ্রীখোল বাজিয়ে পুরস্কার পান ছোট্ট রাধাকান্ত। শুধু তবলা নয় , সব ধরনের তালবাদ্যেই তাঁর ছিল প্রখর জ্ঞান ও সংশয়াতীত দক্ষতা । তাঁর সমকালে তাঁর বিকল্প ছিল না । তাই তিনি যখন খ্যাতির মধ্যগগনে এবং চূড়ান্ত ব্যস্ত , সেই সময়ে তাঁকে নিয়ে চালু হয় ‘ নো রাধাকান্ত , নো রেকর্ডিং ‘ কথাটি । এর চেয়ে বড় সম্মান একজন শিল্পীর জীবনে আর কী হতে পারে ? ছোটবেলায় বাবার শাসন এবং পড়াশোনার চাপ তাঁকে তবলা বাজানোর ইচ্ছা থেকে বিরত করতে পারে নি । শোনা যায় এজন্যই তিনি নাকি পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন ।‌

উস্তাদ আনোখেলাল ছিলেন রাধাকান্ত নন্দীর গুরু ।‌ মার্গসঙ্গীতে তিনি সঙ্গত করেছেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ , উস্তাদ আলি আকবর খাঁ , উস্তাদ আমির খাঁ , পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী , পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় , পণ্ডিত মনিলাল নাগ প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে । আধুনিক বাংলা গান এবং নজরুল গীতিতে তাঁর বাজনা অমর হয়ে আছে । মান্না দে , সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় , মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় , শ্যামল মিত্র এবং সেকালের সমস্ত বিখ্যাত শিল্পীদের কাছে ভীষণ প্রিয় ছিলেন ‘ রাধুবাবু ‘ । তিনি পাখোয়াজ বাজাতেন দুর্দান্ত । দশ রকমের তালবাদ্য অনায়াসে বাজাতেন তিনি ।

তাঁর আরেক গুরু ছিলেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ‌ ঘোষ ।‌ রাধাকান্ত নন্দী প্রসঙ্গে মান্না দে-র মূল্যায়ন অসামান্য । তিনি বলতেন , ‘ রাধুবাবুর মতো ওই সুর তাল বাঁধবে কে ? ও হচ্ছে ন্যাচারাল জিনিয়াস ‘ ।

সত্যিই আজও রেকর্ডে রাধুবাবুর বাজনা শুনে বোঝা যায় কেন তাঁকে বলা হতো জীবন্ত বিস্ময় । তিনি ছিলেন প্রকৃতই কিংবদন্তি । ক্ষণজন্মা এই তালশিল্পীর মাত্রাবোধ আজও সঙ্গীত জগতের চর্চার বিষয় । তবলার বাইরে তাঁর প্রিয় সখ ছিল ছিপ ফেলে মাছ ধরা । ছিপ ও চার হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতেন পুকুরপাড়ে । তখন তাঁর নিবিষ্টতা ও স্থির অচঞ্চল আঙুলগুলো দেখে আন্দাজ করা যেতো না যে এই শান্ত আঙ্গুলগুলোই প্রতি সন্ধ্যার জলসা আর রেকর্ডিং স্টুডিওতে তীব্র গতিময় উঠান আর বক্র তেহাইয়ের বোল ফোটায় বাঁয়া-তবলায় । তখন তিনি যেন এক ধ্যানমগ্ন চিত্রকর । ছন্দোময় আঙ্গুলের ছোঁয়ায় চূড়ান্ত উৎকর্ষতায় অনায়াস নৈপুণ্যে পৌঁছে যান মুগ্ধ শ্রোতাদের নিয়ে । এক মাত্রা থেকে অন্য মাত্রায় , অনন্য মাত্রার এমন এক মায়াজগতের সন্ধান তিনি শ্রোতাদের বারবার উপহার দিয়েছেন যেখান থেকে সহজে ফিরতে চাইতেন না কেউ । মাত্রাবোধের পাঠ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পেতে হয় যে !

আরও পড়ুন- মাঝসমুদ্রে জাহাজে আগুন, নেভাতে নৌসেনার ২৪ঘণ্টার লড়াই

 

Previous articleরবিবাসরীয় কলকাতায় তৃণমূলের ‘পয়মন্ত’ একুশে বৃষ্টি! 
Next articleআত্মতুষ্টি নয়, ‘জাগো বাংলা’য় বার্তা দেওয়ার পর এবার X বার্তা অভিষেকের