‘অদ্ভুত ক্লাব’, উৎপল সিনহার কলম

হোহো হাহা হিহি । চাপা হাসি , মাপা হাসি , নীরব হাসি , ফচকে হাসি , মিচকে হাসি , মুচকি হাসি ইত্যাদি এখানে নিষিদ্ধ । কারণ এটা লাফিং ক্লাব । এখানে সমবেত হাসির বাঁধ ভাঙে । বেশ জোরে জোরে কোমর দুলিয়ে , পাড়া নয় , ত্রিভুবন কাঁপিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে থাকেন এই ক্লাবের সদস্যবৃন্দ ।‌গোমড়ামুখোদের কোনো জায়গা নেই এখানে ।এখানে কারোর চেঁচিয়ে হাসার নেই মানা । কোনো কারণ থাক আর না থাক , আপনাকে হাসতে হবেই । আপনার মনের সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা ভুলে , শোক ও বিষন্নতাকে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে পাঠিয়ে তবেই এই ক্লাব থেকে বেরোতে পারবেন আপনি । সদস্যদের সমবেত হাসির উত্তাল ঢেউ , দামাল ঝড়ের মতো এমন বিকট শব্দের জন্ম দেবে প্রতিমুহূর্তে , যেন হাল্লা চলেছে যুদ্ধে । অনেকে ভাবতেই পারেন , এইসব অবান্তর হাসির পাগলামি জগতের কোনো উপকারে আসে কিনা। ক্লাবের সদস্যদের কাছে এই প্রশ্নের জুতসই জবাব আছে কিন্তু । বাঁচতে হলে হাসতে হবেই । শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে থাকলে হৃদরোগ নাকি অবশ্যম্ভাবি । এই অস্থির সময়ে ঘরে-বাইরের হাজারো টেনশনের ভার লাঘব করতে , মানসিক চাপ কাটাতে হাসির কোনো বিকল্প আজও খুঁজে পায় নি গোটা দুনিয়া । তাই স্ট্রোকের আশঙ্কা কাটাতেই মাস্টার-স্ট্রোক প্রাণ খুলে লাফিং । তবে হ্যাঁ, একা নয় । সবার সঙ্গে সবার রঙে রঙ মিলিয়ে সমস্বরে হাসতে হবে। তবেই নাকি শরীরের অভ্যন্তরে আনন্দ হরমোন নিঃসরণ হবে বেশি , ওই যাকে বলে ডোপামিন , যা আপনার স্ট্রেস , টেনশন কমিয়ে দেবে নিমেষেই । তাই লাফিং ক্লাবে এসে হাহা হোহো হিহি করে শরীর দোলাতে পারলে আপনি ও আপনারা বেঁচে থাকার অক্সিজেন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পাবেন , মনের চাপ যাকে বলে যাচ্ছেতাই রকমের কমবে , আর বাড়তে থাকবে পরমায়ু ।

ক্রাইং ক্লাব আছে কিনা কে জানে ! তবে দুনিয়া জুড়ে অদ্ভুত ধরনের ক্লাবের অভাব নেই কোনোকালেই । এই তো সেদিন কাগজ পড়তে পড়তে চোখে পড়লো অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে নাকি বিচিত্র ধরনের ক্লাবের রমরমা ছিল । লন্ডনে একটা অদ্ভুত ক্লাব ছিল , যার নাম ছিল ‘ হাঁড়িমুখো ক্লাব ‘ । এই ক্লাবে তারাই সভ্য হতে পারতো যাদের ব্যবহার ছিল ভীষণ অভদ্র এবং যারা সর্বদাই বিষন্ন ও বিমর্ষ হয়ে থাকতো । যে সব লোকজন ভুলেও হাসে না , সবসময় মুখ হাঁড়ি করে থাকে এবং ভদ্রভাষা জানে না , শুধুমাত্র তারাই এই ক্লাবের সভ্য হতে পারতো । আর ছিল ‘ কিপটে ক্লাব ‘ । মানে কৃপণদের ক্লাব । যারা ছিল হাড়কিপ্টে , যারা তাদের পাওনাদারদের দেখলেই লাঠি হাতে রেরে করে তাড়া করতো এবং দিনের পর দিন না খেয়ে টাকাপয়সা জমিয়ে নিজেদের সিন্দুক মোটা কোলাব্যাঙের মতো করে তুলতো , কেবলমাত্র তারাই সসম্মানে এই অদ্ভুত ক্লাবের সদস্যপদ লাভ করতো ।

হাড়বজ্জাতদের কোনো ক্লাব কোথাও আছে কিনা জানা নেই । তবে পৃথিবীর প্রতিটি কোনে হাড়বজ্জাতেরা প্রতিনিয়ত বর্তমান । এদের ক্লাব থাকলে সদস্য উপচে পড়বে । সেই প্রাচীন সময়ে আরেকটা খুব মজার ক্লাব ছিল , ডাহা মিথ্যেবাদীদের ক্লাব । এই ক্লাবের সদস্যেরা পরস্পরের কাছে লাগাতার মিথ্যে বলে যেতো এবং নানা উদ্ভট বিষয়ের অবতারণা করতো । এদের মধ্যে কেউ যদি ভুলেও কোনো একটা সত্যি কথা বলে ফেলতো তাহলে তৎক্ষণাৎ তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যেতো এবং তাকে ক্লাব থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হতো ।

কুৎসিত বা কদাকারদেরও নাকি একটা ক্লাব ছিল । কী বীভৎস ব্যাপার ! আর ছিল ‘ অভাগা ক্লাব ‘ । দুনিয়ার যত হতভাগা এই ক্লাবে এসে নাম লেখাতো । দুর্ভাগ্য নাকি এদের তাড়া করে বেড়াতো সারাজীবন । আর বারোমাস যারা রোগে ভুগতো , তাদেরও একটা ক্লাব ছিল , বারোমেসে রোগীদের ক্লাব ।

এ তো গেল দু’শো বছর আগেকার ইউরোপের অদ্ভুত সব ক্লাবের কথা । আমাদের এই বৈচিত্র্যময় দেশে , মহামানবের সাগরতীরে এমন সব আশ্চর্য উপাদান ‌প্রায় প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে পড়ে যে , চাইলে এখানে অদ্ভুত ক্লাবের মেলা বসিয়ে দেওয়া যায় । প্রথমেই যে ক্লাবটার সদস্যপদ পেতে লম্বা লাইন লেগে যাবে তার নাম রাখা যেতে পারে ‘ হুঁকোমুখো হ্যাংলা ‘ । কাতুকুতু বুড়োদের নিয়ে একটা ক্লাব করা গেলে হুড়োহুড়ি সামাল দেওয়া মুশকিল হবে । ক্লাব হিসেবে ‘ কুমড়োপটাশ ‘ জনপ্রিয় হবেই । তবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকবে ‘ খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না ‘ ক্লাব ।