বোরোলিনের (Boroline) বয়স এখন ৯৬ বছর। একইভাবে বছরের পর বছর ধরে মানুষ এটি ব্যবহার করে যাচ্ছে। ব্যবহার করতে পছন্দ করছেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক টিপসেই হু হু করে বিক্রি বেড়েছে বোরোলিনের।

সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন। এই জিঙ্গেলটি এখনও মানুষের মুখে মুখে। পরে ঋতুপর্ণ ঘোষ ট্যাগ্লাইন হিসেবে লিখেছিলেন ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ‘! বোরোলিনের জিঙ্গেলটির জন্য যে গান রচনা করা হয়েছিল তার গীতিকার ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গেয়েছিলেন শ্রাবন্তী মজুমদার। মিউজিক কম্পোজ করেছিলেন ভি.বালসার।

জীবনের নানা ওঠাপড়া যেন সহজে গায়ে না লাগে
বোরোলিনকে জীবন সংগ্রামের ভরসাযোগ্য এঁকোটি পণ্য হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। বর্তমানে বোরোলিনের অ্যাম্বাসাডার হলেন বলিউড অভিনেত্রী বিদ্যা বালান।

কোম্পানির ইতিহাস
বোরোলিন (Boroline) হল জিডি ফার্মাসিউটিক্যালস (GD Pharmaceuticals) নামক একটি ভারতীয় কোম্পানি। ১৯২৯ সালে কলকাতায় বাঙালি ব্যবসায়ী গৌরমোহন দত্ত একটি দেশীয় অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম হিসেবে বোরোলিন চালু করেন। যা তখন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বদেশী আন্দোলনের অংশ ছিল। জিডি ফার্মাসিউটিক্যালস পরিচিত জনগণের বোরোলিন নামেও।

আরও পড়ুন-গুচ্চি সবচেয়ে সস্তা কোথায়? কেন সেলিব্রিটিরা এত পছন্দ করেন

বোরোলিনের গুণগত মানোন্নয়নে অবদান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
বোরোলিন নির্মাতাদের ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের ‘প্রোডাক্ট’-এ বেশ কিছু বদল আনার পরামর্শ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, বোরোলিনের যে টিউব ও কৌটোগুলি রয়েছে তাতে ক্রিমটা আঠার মতো লাগছে। সেই জন্য বোরোলিনের বিক্রি কমছে। তিনি নির্মাতাদের বলেছিলেন,বোরোলিনটা সফ্ট করতে। যাতে ঠোঁটে দিলে অনুভবই না হয়। তিনি চন্দনের পরামর্শও দিয়েছিলেন। তারপরেই আরও বিক্রি বেড়ে গিয়েছে বোরোলিনের।

কী কী দিয়ে তৈরি হয় বোরোলিন?
এটি ছিল ভারতে তৈরি প্রথম অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমগুলির মধ্যে একটি। এতে ব্যবহৃত বোরিক পাউডার থেকে ‘বোরো’ কথাটি এসেছে এবং ‘ওলিন’ হল ল্যাটিন শব্দ ‘ওলিয়াম’-এর বিকল্প, যার অর্থ হল তেল। এই ক্রিমটি আসলে কিছু প্রয়োজনীয় তেল, মোম এবং গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিসেপ্টিক উপাদান বোরিক পাউডার ও জিঙ্ক অক্সাইডের মিশ্রণে তৈরি। এই কারণে চামড়ার ওপর কাটাছেঁড়ায় ম্যাজিকের মতো কাজ করে। আজ, এটি ভারতের অন্যতম পরিচিত এবং বিশ্বস্ত সুপারব্র্যান্ড, যা তিন প্রজন্মের বেশি সময় ধরে ভারতীয় পরিবারে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০০৩ সাল থেকে একটানা ইন্ডিয়ান সুপার ব্র্যান্ডের খেতাবও পেয়ে আসছে এই কোম্পানিটি।

কে ছিলেন গৌর মোহন দত্ত?
গৌর মোহন দত্ত ছিলেন বিদেশী পণ্যের আমদানিকারক। যোগ দেন স্বদেশী আন্দোলনে। বুঝেছিলেন ভারতকে সাহায্য করার সর্বোত্তম উপায় হল – এটিকে আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। তাই তারা এমন পণ্য তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা মানসম্মত বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। অনেকে তাঁর উদ্যোগের বিরোধিতা করলেও গৌর মোহন হাল ছাড়েননি। ভারতকে স্বাধীন ও স্বনির্ভর করার স্বপ্নকে হৃদয়ে রেখে তিনি নিজের বাড়িতে বিদেশী পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশীয় পণ্য তৈরি শুরু করেন। তাদের মধ্যে একটি ছিল এই বোরোলিন ক্রিম যা একটি সবুজ টিউবে পাওয়া যেত।

কারা ব্যবহার করেছেন?
বোরোলিনের (Boroline) জনপ্রিয়তার খবরে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং অভিনেতা রাজকুমার এটি ভিষণভাবে ব্যবহার করতেন। আরও অনেক সেলিব্রিটিরা বোরোলিন ব্যবহার আগেও করতেন, এখনও অনেকে এটি বেশ পছন্দ করেন।

স্বাধীনতায় বিনামূল্যে বিতরণ
দেশের স্বাধীনতায় বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে এক লক্ষ বোরোলিন৷ ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট যেদিন ভারত স্বাধীন হয়, সেদিন জিডি ফার্মাসিউটিক্যালস এই আনন্দ উপলক্ষ্যে সাধারণ জনগণের জন্য বিনামূল্যে ১,০০,০০০ বোরোলিন টিউব বিতরণ করেছিল।
আরও পড়ুন-ক্রকসের জুতোর ম্যাজিক কী? কেন প্রায় সবার পায়ে? কেন দাম বেশি?
পণ্যের পরিসর
কোম্পানিটি এখন সুথল (Suvtholl), এলিন হেয়ার ওয়েল (Elin Hair Oil), গ্লোসফ্ট (Glossoft) ফেস ওয়াশ এবং পেনোরুব (Penorub) এর মতো বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে।
বিদেশে বোরোলিনের চাহিদা
বোরোলিনের চাহিদা বিদেশে বিশেষ করে ভারতীয় প্রবাসী এবং মধ্যপ্রাচ্যে। মাত্রা ছাড়া চাহিদা রয়েছে। ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুর–সহ অনেক দেশে গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে রফতানি করলেও, ভুটান, সংযুক্ত আরব আমিরাশাহ, নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ, কানাডার মতো দেশগুলিতেও এর চাহিদা রয়েছে।
জিডি ফার্মাসিউটিক্যালসের বার্ষিক টার্নওভার
এই কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার ২৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র বোরোলিনেরই বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ১৭০ কোটি টাকা।