নকশালবাদ ও ভারত সরকারের বর্তমান নীতি

Date:

Share post:

কেন্দ্রীয় সরকার নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও পুনর্বাসন, এই তিনটি স্তম্ভের সমন্বয়ে ভারতের নকশাল দমন কৌশলে আমূল পরিবর্তন এনেছে। অতীতের বিচ্ছিন্ন প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপগুলি পরিত্যাগ করে, সরকার এখন কেন্দ্রীভূত সংলাপ-নিরাপত্তা-সমন্বয়- ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। লক্ষ্য ২০২৬-এর মার্চের মধ্যে সমস্ত প্রভাবিত জেলাকে নকশাল-মুক্ত করা।

গত দশকে নিরাপত্তা বাহিনী ও উন্নয়নমূলক উদ্যোগের সমন্বিত প্রচেষ্টায় নকশাল হিংসা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০০৪–২০১৪ ও ২০১৪–২০২৪ সময়কালের তুলনায় হিংসার ঘটনা ১৬,৪৬৩ থেকে ৭,৭৪৪-এ নেমেছে। নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যু ১,৮৫১ থেকে ৫০৯-এ এবং নাগরিকদের মৃত্যু ৪,৭৬৬ থেকে ১,৪৯৫-এ নেমে এসেছে। এটি প্রভাবিত অঞ্চলে শান্তি ও শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।

শুধু ২০২৫ সালেই নিরাপত্তা বাহিনী ২৭০-জন নকশালকে নির্মূল করেছে। গ্রেফতার করেছে ৬৮০-জনকে। ১,২২৫ জনের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করেছে। অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্টের মতো বড় অভিযানের পাশাপাশি ছত্তিশগড়ের বিজাপুর ও মহারাষ্ট্রে ব্যাপক আত্মসমর্পণের ঘটনা প্রমাণ করে যে সশস্ত্র আতঙ্কবাদীরা ক্রমশ জীবনের মূলধারায ফিরছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের নিরাপত্তা পরিকাঠামোর উপর গুরুত্ব নকশালবিরোধী লড়াইয়ে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। গত দশকে ৫৭৬টি সুরক্ষিত থানা নির্মিত হয়েছে এবং ৬বছরে ৩৩৬টি নতুন নিরাপত্তা শিবির স্থাপন করা হয়েছে। নকশালপ্রভাবিত জেলার সংখ্যা ২০১৪-এর ১২৬ থেকে ২০২৪-এ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত জেলা এখন মাত্র ৬টি। রাতে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য ৬৮টি হেলিপ্যাড নির্মাণের ফলে গতিশীলতা ও অভিযানের প্রতিক্রিয়া সময় উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।

নিরাপত্তা সংস্থাগুলি এখন নকশালদের কার্যকলাপ নীবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য লোকেশন ট্র্যাকিং, মোবাইল ডেটা বিশ্লেষণ, বৈজ্ঞানিক কল লগ পরীক্ষা, ও সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষণের মত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। বিভিন্ন ময়নাতদন্ত ও প্রযুক্তিভিত্তিক সংস্থার সহায়তায় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও অভিযানের দক্ষতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি, ড্রোন নজরদারি, স্যাটেলাইট ইমেজিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ ব্যবহারের মাধ্যমে জরিপ ও কৌশলগত পরিকল্পনা আরও কার্যকর হয়েছে।

নকশালবাদের আর্থিক জাল-বিস্তার সুসংগঠিতভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় তদন্ত সংস্থা বা এন আই-এর একটি বিশেষ শাখা ৪০ কোটির টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট ১২ কোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে। রাজ্য প্রশাসনগুলিও ৪০ কোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে। তথাকথিত ‘আরবান নকশাল’দের প্রচারের ক্ষমতাও হ্রাস করা গিয়েছে।

প্রতিরক্ষা খাতে গত ১১ বছরে ৩,৩৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগের দশকের তুলনায় এটি ১৫৫% বেশি। বিশেষ পরিকাঠামো উদ্যোগের অধীনে ৯৯১ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়েছে বিশেষ বাহিনী, গোয়েন্দা শাখা ও সুরক্ষিত থানার জন্য।

২০১৭–১৮ থেকে ১,৭৪১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে এবং ৪৪৫ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বিশেষ কেন্দ্রীয় সহায়তার অধীনে ৩,৭৬৯ কোটি টাকা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। পাশাপাশি, “ACALWEMS” উদ্যোগের অধীনে ১২২.২৮ কোটি টাকার ক্যাম্প পরিকাঠামো ও ১২.৫৬ কোটি টাকার স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ করা হয়েছে।

নকশালপ্রভাবিত এলাকায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত করতে পরিকাঠামোর উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

নিরবচ্ছিন্ন অভিযানের মাধ্যমে সরকার তিন দশক ধরে নকশাল প্রভাবিত বহু এলাকা পুনর্দখল করা হয়েছে। “খোঁজ, লক্ষ্য, দমন” কৌশলের ফলে শীর্ষ নকশাল নেতৃত্বকে সনাক্ত করে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। অপারেশন অক্টোপাস, ডাবল বুল ও চক্রবাঁধা সফলতার নজির স্থাপন করেছে।

২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ৫২১- জন নকশাল আত্মসমর্পণ করেছেন। গত দুই বছরে ছত্তিশগড়ে ১,০৫৩ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। পুনর্বাসনের মধ্যে উচ্চপদস্থদের জন্য ৫ লাখ, মধ্য ও নিম্নপদস্থদের জন্য ২.৫ লাখ টাকা এবং তিন বছরের জন্য মাসিক ১০,০০০ ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

ভারতের নকশালবিরোধী অভিযান এখন নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে এক সমন্বিত আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। শক্তিশালী পরিকাঠামো, আধুনিক প্রযুক্তি, লক্ষ্যভিত্তিক বাস্তবায়ন ও সহানুভূতিশীল পুনর্বাসনের সমন্বয়ে সরকার একসময় উপদ্রুত অঞ্চলগুলিকে সুযোগের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ প্রচেষ্টার ফলে ২০২৬-এর মার্চের মধ্যে নকশাল-মুক্ত ভারত গঠনের লক্ষ্য এখন নাগালের মধ্যে।

আরও পড়ুন – মহারাষ্ট্রের চিকিৎসক আত্মহত্যায় কোন সাংসদ জড়িত: নাম প্রকাশের দাবি তৃণমূলের

spot_img

Related articles

বাংলার বকেয়া না দিলে ফের মেগা ধরনা দিল্লিতে, হুঁশিয়ারি অভিষেকের

বাংলার বকেয়া না দিলে আবারও দিল্লিতে মেগা ধরনা হবে, হুঁশিয়ারি দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। একশো...

গাছের মগডালে ৭৩৮ দিন! প্রকৃতির সৃষ্টিকে বাঁচাতে তেইশ বছরের জুলিয়ার লড়াকু বাস্তব কাহিনী

'গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান' কথাটা বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে দেওয়াল লিখন কিংবা পরিবেশ দিবসের দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের...

‘অশান্ত কমলাকান্ত’, উৎপল সিনহার কলম

অশান্ত কমলাকান্ত বলে দিয়ে গালাগালি -- এবার সর্বনাশি , ধ'রে অসি, ধর্মাধর্ম দুটোই খেলি।এই সেই আশ্চর্য গান , যা আজও শ্রোতাদের...

থামল লুনার সওয়ারি: শেষ হল অ্যাডম্যান পীযুশ পাণ্ডের ফেভিকলের সফর

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন থেকে অডিও ভিস্যুয়াল বিজ্ঞাপনে যখন পাড়ি দিয়েছিল আমাদের দেশের বিজ্ঞাপনীমহল, তখন নিজে হাতে ধরে সেই...