তেজস্বীতেই নড়বড়ে মোদি, কী হবে মমতায়? কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

খুব বেশি হলে বয়স এখন ৩০-৩১, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও আহামরি নয়৷

আর তাঁকে রুখতে আসরে নেমেও খেই হারাচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী৷
ভোট প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিশানা করেছেন তাঁকেই। নীতীশ কুমারের কথা বাদ দেওয়া যেতেই পারে, কারন, তিনি তো দিনরাত ওই নামই জপে চলেছেন৷

ইনি তেজস্বী যাদব৷ ভোটের ফল যাই হোক, বিহারে এই মুহূর্তে বিজেপি-জেডিইউয়ের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছেন তিনি৷
অথচ বিজেপির অঙ্ক ছিলো অন্যরকম৷ অনেক ছক কষে করোনা-কালেই
ভোট করিয়ে অপ্রস্তুত থাকা সব প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার পরিকল্পনা ছিলো৷ সেই মেজাজে জেডিইউকে সঙ্গী করে আসরেও নেমেছিলো বিজেপি। কিন্তু, বিষয়টি তেমন থাকলো না৷ ভোটের চাকা যত গড়িয়েছে, ততই প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে সামনে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছেন ওই ‘অনভিজ্ঞ’ তেজস্বী ৷ বিজেপি এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, যতটা ভাবা গিয়েছিলো, প্রতিপক্ষ আদৌ ততটাও দুর্বল নয়, বরং বিষয়টা উল্টো৷

কী করছেন তেজস্বী ?

এই শনিবারের কথাই বলা যাক৷ শনিবার তেজস্বী যাদব যে ভাবে মোদির একটি পুরনো ভিডিওকে অস্ত্র করে নীতীশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন তা ভোটের বিহারে শোরগোল ফেলে দিয়েছে ! ৫ বছর আগের ভোটে তৎকালীন প্রতিপক্ষ নীতীশের বিরুদ্ধে ৩৩টি দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন এই নরেন্দ্র মোদিই। ভোট প্রচারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে রীতিমতো সেই তালিকা ধরে একের পর এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন মোদি৷ শনিবার মোদির সেই ভিডিওকে টুইটারে পোস্ট করে তেজস্বী লেখেন, “নীতীশজির আমলে ৩০ হাজার কোটি টাকার কম করে ৬০টি দুর্নীতি হয়েছে। যার মধ্যে ৩৩টি মোদিজি নিজেই কয়েক বছর আগে বলে দিয়েছেন। এবার আপনারা প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে নিন…”
পরিপক্ক গেরুয়া শিবির এবং জেডিইউ নেতারা তেজস্বীর এই আপাত ‘নরম’ বক্তব্যে চূড়ান্ত বিপাকে পড়েছে৷ মোদির ওই ভিডিওকে ভুয়োও বলতে পারছে না৷ না বলতে পারার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আনা নীতীশ কুমারের আর্থিক-দুর্নীতির অভিযোগ ‘স্ট্যান্ড’ করে যাচ্ছে৷ প্রতিবাদ করলেই প্রমান হয়ে যাবে, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেও মোদি সহজেই অসত্য অভিযোগ আনতে পারেন৷

আরও পড়ুন:বিরুদ্ধে নয়, প্রশাসনের পাশেই দাঁড়ালো কোর্ট, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

আবার এটাও বলতে পারছেনা, মোদি সেদিন যা বলেছেন, তা ঠিক৷ বস্তুত তেজস্বীর কোনও জবাবই দিতে পারছে না! প্রতিপক্ষ-নিধনের কৌশলে ১০০ শতাংশ সফল তেজস্বী৷ এ বিষয়ে কিছু বলতে না পেরে বিজেপি-জেডইউ বেশি করে ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে চলে গিয়ে এক ধাক্কায় বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে তেজস্বীকেই৷ বিহারের শাসক শিবির যত ব্যক্তিগত আক্রমণে যাচ্ছে তেজস্বীর মুখে ততই শোনা যাচ্ছে তাঁর ইস্তেহার, “পড়াই, কামাই, সিচাই, দাওয়াই”৷ অস্বস্তি বাড়ছে বিজেপির৷ মোদি-নীতীশ যখন ভোটের লড়াইয়ে হামেশাই তেজস্বীর জেলবন্দি পিতা লালুপ্রসাদকে টেনে আনছেন৷ এর উত্তরে ঠাণ্ডা গলায় তেজস্বী বল চলেছেন, “আমি বিহারের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে চাইছি, কিন্তু মোদিজি- নীতীশজি ততই অতীতে গিয়ে বসে আছেন! আপনারাই এবার বুঝে নিন কী করবেন ?” এর জবাব দিতে এখনও পর্যন্ত সফল হননি মোদি বা নীতীশ৷

তেজস্বী-ফোবিয়ায় এতটাই আক্রান্ত হয়েছে বিজেপি যে এই ‘অনভিজ্ঞ’ তরুনের মোকাবিলা করতে আগামী দু’দফার ভোটে রণকৌশল ঢেলে সাজাতে হচ্ছে পদ্ম-শিবিরকে! এতদিন বিজেপির প্রচার ছিল দলকেন্দ্রিক৷ বিজেপি কত ভালো, জেডিইউ কতখানি সুশাসক, অন্যদিকে আরজেডি বা কংগ্রেস কতখানি ‘পচা’- এ সবই বোঝাচ্ছিলো বিহারের শাসক-জোট৷ এতে কাজ হয়নি৷ ফলে মাঝপথে এসে ‘কৌশল’ বদলাতে হচ্ছে বিজেপিকে৷ এবারের প্রচার তেজস্বী- কেন্দ্রিক। তেজস্বী সুশাসক নন, তেজস্বী শিক্ষিত নন, তেজস্বী জেলবন্দি লালুপ্রসাদের ছেলে ইত্যাদি ৷ এর অর্থ, বিহার ভোটে ঠিক এতটাই দাপট দেখিয়ে চলেছেন তেজস্বী যাদব৷ বিহারবাসী মেনে নিয়েছেন, ভোটের ফল যাই হোক, বিহারে এবার তেজস্বী একাই একশো!

সত্যিই তেজস্বী যাদব একাই চষে ফেলছেন গোটা বিহার৷ ঝড়ের বেগে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে৷ বক্তৃতাতেও চমক দেখাচ্ছেন, একদিন তোপ দাগছেন নীতীশ কুমারকে, তো পরের দিনের টার্গেট নরেন্দ্র মোদি৷ ধারালো আক্রমণ৷ সহজ সরল ভাষা৷ চরম বিড়ম্বিত নীতীশ কুমার আর বিজেপি৷ নীতীশের জেডিইউ তেজস্বীকে ‘অনভিজ্ঞ যুবরাজ’ বলে কটাক্ষ করছে, কিন্তু ঠেকাতে পারছেনা৷ ৩০ বছরের এই ‘অনভিজ্ঞ যুবরাজ’-কে টক্কর দিতে দফায় দফায় দিল্লি-সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে ফৌজ উড়িয়ে আনতে হচ্ছে বিজেপিকে। ঠিক যেমন গেরুয়া শিবির করেছিলো দিল্লি ভোটে কেজরিকে আটকাতে৷ তবুও শোচনীয় পরাজয় দিল্লিতে ঠেকাতে পারেনি বিজেপি৷ দেখা যাচ্ছে, বিহারেও খোদ প্রধানমন্ত্রী এসে নিশানা করেছেন সেই তেজস্বীকেই। তাঁকে রুখতে আগামী দু’দফার ভোটে রণকৌশল বদলাতে চলেছে পদ্ম শিবির! এবার থেকে বিহারে বিজেপির প্রচার হবে তেজস্বী-কেন্দ্রিক। এই নির্দেশও দিল্লি থেকে চলে গিয়েছে বিহার বিজেপির কাছে৷

ভোট প্রচারের মঞ্চ থেকে এই প্রজন্মের রাজনীতিক যখন আগামীদিনের বিহারের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তখন শ্রোতারা দু’হাত তুলে সমর্থন করছেন তেজস্বীকে৷ এ দৃশ্য বার বার দেখা গিয়েছে৷ তেজস্বীর সভায় উপচে পড়া ভিড় এবং তাঁর কপ্টার ঘিরে উচ্ছ্বাস এখন প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউত তো এমনও বলেছেন, “প্রথম দফার ভোটের পর মনে হচ্ছে তেজস্বী মুখ্যমন্ত্রী হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’

বিহারবাসীর এই বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস যদি EVM পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তাহলে মোদি-বাহিনী কোন মুখে বাংলায় ঢুকবেন, রাজনৈতিক মহল সেটাও ভাবছে৷

পরের পর রণকৌশল বদল করেও বিজেপি আশার আলো কিছু দেখতে পাচ্ছে না এখনও পর্যন্ত৷ সূত্রের খবর, দিল্লির শীর্ষ বিজেপি নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও চওড়া হয়েছে বিহারে প্রথম দফার ভোটের পর দলের নিজস্ব সমীক্ষার রিপোর্ট হাতে আসার পর৷ রিপোর্টে তেজস্বীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং বিহারবাসীর মনে সেই জনপ্রিয়তার প্রভাব ধরা পড়েছে। এর পরেই পরের ২ দফার প্রচারে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপানোর সিদ্ধান্ত নেয় শীর্ষ নেতৃত্ব। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভা৷ প্রথম দফায় ৭১ আসনে ভোট হয়েছে৷ পরের দুই দফায় মোট ১৭২টি আসনে ভোট হতে চলেছে৷ এই দুই পর্বের ফলাফলের উপরেই নির্ভর করবে বিহারের ভবিষ্যৎ৷

নিতান্তই ‘অনভিজ্ঞ- অশিক্ষিত’ তেজস্বীকে ঠেকাতেই নাজেহাল বিজেপি-জেডিইউ’র ‘ডাকসাইটে’ নেতারা৷
তেজস্বীকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিহারবাসীর এই বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস যদি EVM-এ পৌঁছে যায়, তাহলে নরেন্দ্র মোদি কোন মুখে বাংলায় ঢুকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোকাবিলা করবেন, তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে রাজনৈতিক মহলকে৷

আরও পড়ুন:অবিমৃশ্যকারিতা! কণাদ দাশগুপ্তর কলম