অবিমৃশ্যকারিতা! কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

একইসঙ্গে চোরকে চুরি করার এবং গৃহস্থকে সতর্ক থাকার ‘পরামর্শ’ দেওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, চলতি বছরের দুর্গোৎসব৷

অথচ, আমরাই একদিন সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য তবলিগ জামাতকে অভিযুক্ত করেছিলাম৷ আজ কীভাবে সেই অভিযোগের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবো ? এই পুজোকে কেন্দ্র করে মহাবিপর্যয়ের একটা আশঙ্কাকে আমরাই ডেকে আনছি৷ সত্যিই তেমন কিছু হলে, তার দায় কে নেবে?

‘কোভিড-মুক্ত দেশ বা রাজ্য’ ঘোষণার কোনও গাইডলাইন এখনও প্রকাশ্যে আসেনি৷ কোন কোন শর্ত পূরণ হলে ‘কোভিড-মুক্ত’ বলা যাবে, সেই বিষয়টিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক বা ICMR এখনও আলোচনার টেবিলে আনতে পারেনি৷ পারার কথাও নয়৷ কারন, করোনাভাইরাস এখনও ‘মুক্তি’ দেয়নি৷ উল্টে রবিবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বাংলা-সহ একাধিক রাজ্যে ‘গোষ্ঠী-সংক্রমণ’ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন৷ তাই এ রাজ্যে করোনা-ত্রাস আজও বহাল৷

উৎসবের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে ভালো নেই বাংলা৷ সরকারি তথ্য বলছে, রাজ্যে কোভিড- আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে৷ দীর্ঘায়িত হচ্ছে মৃত্যুমিছিল৷ মাঝে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, শ্লথগতিতে হলেও স্বস্তির পথে হাঁটছিলো বাংলা৷ কিন্তু রাজ্যজুড়ে নানা রংয়ের রাজনৈতিক কর্মসূচির সংখ্যা হঠাৎই বেড়ে যাওয়ায় এবং সরকারি অনুমতিক্রমে ঘাটে ঘাটে মহালয়ায় বেলাগাম তর্পণের জেরে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কিত৷ আর এবার, পুজোর মধ্যে অথবা পুজোর অব্যবহিত পর এই অতিমারি মহাসর্বনাশের পথে ঠেলে দেবে বাংলাকে৷

দুর্গাপুজো-কেন্দ্রিক স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা SOP-তে যা যা বলা হয়েছে, তা
লঙ্ঘন করার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গিয়েছে৷ যে শর্তে পাড়ার ক্লাবগুলি ৫০ হাজার টাকার ‘উৎসাহ-ভাতা’ পেয়েছেন, দ্বিতীয়া থেকেই সে সব শর্তকে বুড়ো আঙুল দেখানো শুরু হয়ে গিয়েছে৷ ওদিকে, থানায় লোকবলের অভাবে পুলিশের পক্ষে এলাকার সব পুজোয় সমান নজর রাখা কার্যত অসম্ভব৷ সরকারি টাকা হস্তগত হওয়ার পর পুজো কমিটি নিজেদের দায় পালনে কতখানি তৎপর, দ্বিতীয়ার ‘প্যাণ্ডেল-হপিং’ সেই প্রশ্নই তুলে দিচ্ছে৷ এর সমাধান কেমনভাবে হবে?

এসব ছবি নানা আশঙ্কা আর উদ্বেগ জাগালেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ এখনও পর্যন্ত শুধুই নির্দেশিকা- জারি কেন্দ্রিক৷ অথচ, হাতেই আছে কেরলের টাটকা উদাহরণ৷ ওনাম উৎসব পালন করে কেরল দেশের সব রাজ্যকে সংক্রমণে হারিয়ে দখল করেছে প্রথম স্থান৷ এখনও পর্যন্ত সামনে কোনও ‘চ্যালেঞ্জার’ নেই৷ দিনকয়েক পর ‘খেতাব’ ধরে রাখতে কেরলকে হয়তো লড়তে হবে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে৷ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সেদিন কেরলের পক্ষে বাংলাকে হারানো কঠিন হবে৷ বাংলার ‘সাফল্য’ দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র দিন দশেক৷

ওনামের থেকে দুর্গাপুজোর পরিধি বহুগুণ বড়৷ ওনামের আগে কেরল সরকার বেশ কিছু নির্দেশ জারি করেছিলো৷ কী করতে হবে, কী করা যাবেনা, বিজয়ন সরকার কেরলবাসীকে তা জানিয়েছিলো৷ ওই নির্দেশিকা বা SOP মানা হচ্ছে কি’না, তা দেখবে প্রশাসন, এমনও বলেছিলো কেরল সরকার৷ সতর্কবিধি জারি করে দায় সারতে তথাকথিত ‘কঠোর নজরদারি’র পরেও কেরল সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ৷ এ রাজ্যের সরকার দুর্গাপুজো নিয়ে ‘কড়া’ নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে৷ সরকার বলেছে, “দুর্গাপুজো-সংক্রান্ত নির্দেশিকা বা SOP মানা হচ্ছে কি’না, তা দেখবে প্রশাসন৷” এখনই যে সব ছবি সামনে আসছে, তাতে ধন্দ জাগছে, কেরল যা পারেনি, বাংলা তা কতখানি পারবে এবং কীভাবে পারবে? কেরল-পরিসংখ্যানকে সামনে রেখেই এ রাজ্যের চিকিৎসক- বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ষষ্ঠী-সপ্তমী থেকেই বাংলায় দৈনিক সংক্রমণ দাঁড়াতে পারে ১২-১৩ হাজারে৷ এর মধ্যে কতজন ‘করোনা-জয়ী’ হয়ে ফিরতে পারবেন, তা আগাম আন্দাজ করা কঠিন৷ রাজ্যের বহু জেলায় এখনও সেইভাবে চিকিৎসা পরিকাঠামোই গড়ে তোলা যায়নি৷ পুজোর পরে সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কায় প্রশাসন সবে জেলাস্তরে কোভিড-শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে নেমেছে৷​ সরকার নিজেই আশঙ্কিত,পুজোর পরে হাসপাতালগুলিতে কোভিড- চিকিৎসার বেড হয়তো থাকবে না৷
হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা সীমিত। টানা মার্চ- এপ্রিল থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ কেউ কোনও ছুটি পাননি। লাগাতর এত পরিশ্রম করা শারীরিকভাবেই অসম্ভব৷ ফলে পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমছে। তাহলে দুর্গাপুজোর সময় বা পুজোর পর সংক্রমণ মাত্রাছাড়া হলে তা ঠেকানোর উপায় কী? ​ প্রশাসনের নজরের বাইরে তো কিছু নেই৷ সবাই সব জানে৷ এ কোন অশনি সংকেত? কেরলের কোভিড-পরিসংখ্যান নিশ্চিত করছে, ওনাম উৎসবের কারণেই ওই রাজ্যের স্বাস্থ্যপরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে৷ কিন্তু এরপরেও কি রাজ্য প্রশাসন সতর্ক হবে না?

পুলিশ, প্রশাসন, পুজো কমিটি বা ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’ সতর্কতামূলক যে ধরনের পদক্ষেপের কথা বলে চলেছে, তার একশো শতাংশ বাস্তবায়ন কার্যত অসম্ভব৷ এক্ষেত্রে নানা সমস্যা মাথাচাড়া দেবে৷ ভোটের বছর, তাই থাকবে গোপন- রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও৷ দুর্গাপুজোর মতো মহোৎসব, যেখানে আমজনতার অংশগ্রহণই মুখ্য বিষয়, সেখানে সব সময় লাঠি উঁচিয়ে বিধি মানানো অসম্ভব৷ তেমন ঘটনা পুলিশ বিচ্ছিন্নভাবে ঘটালে, সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হবে৷ কারন, ভোট বড় বালাই৷ তাছাড়া, বিরোধীরা ওই ইস্যুতে পথে নামলে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটতে পারে ৷

সুতরাং এ বছরের দুর্গাপুজোর ইতিবাচক দিক কার্যত একটিও নেই৷ বরং শারীরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক, প্রতিটি ধাপেই শারদোৎসবের অনুভূতি অনুভব করার প্রশ্নে সম্পর্কশূন্যতাকেই পরিস্ফুট করছে৷

তবুও প্রশাসনিক সহযোগিতার জোরে এ বছরও আমরা একই মেজাজে পুজোয় মেতেছি৷ পুজোর আয়োজক হলে, পুজোর মদতদাতা হলে, পুজোর হুল্লোড়ে গা ভাসালে করোনা ‘ভয়ে’ পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, বিশেষ গবেষণালব্ধ এমন কিছু তথ্য তো এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেনি,

তাহলে এই অবিমৃশ্যকারিতা কেন ?

আরও পড়ুন-প্রত্যেকটি পুজো মণ্ডপ হোক কনটেনমেন্ট জোন- শুনানিতে মন্তব্য হাইকোর্টের

Previous articleউত্তরবঙ্গে পৌঁছেই কালীবাড়িতে পুজো, দিনভর বৈঠক কর্মসূচি নাড্ডার
Next articleনভেম্বরেও স্নাতকে ভর্তি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে